রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি ৯০ শিক্ষার্থীর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে যা জানা গেল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোববার দুপুরে হাসপাতালের আট নম্বর ওয়ার্ডে
ছবি: প্রথম আলো

ইটের আঘাতে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। হাসপাতালের শয্যায় জায়গা পাননি। অন্য একজন রোগীর শয্যার পাশে বসে আছেন। ছবি তুলতে গেলে ব্যান্ডেজ জড়ানো মাথাটা নিচু করলেন। নামও বলতে চান না। কারণ হিসেবে বললেন, পত্রিকায় নাম ছাপালে বাড়িতে মা-বাবা কষ্ট পাবেন।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর ফটকের পাশে স্থানীয় ব্যক্তিদের হামলা-সংঘর্ষ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া কাঁদুনে গ্যাসের শেলে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন

তাঁদের মধ্যে এখনো ৯০ জন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আছেন এক শিক্ষার্থী। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। আজ রোববার দুপুরে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। ছয়জন শিক্ষার্থীর চোখে রাতেই অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও নগরবাসী বলছেন, একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রীতি হয়ে গেছে। তবে এক দিনে এত শিক্ষার্থী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা অতীতে কবে ঘটেছে, তা অনেকেই স্মরণ করতে পারছেন না।

আরও পড়ুন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত শিক্ষার্থী। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন
ছবি: প্রথম আলো

আজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, আহত শিক্ষার্থীদের অনেকেরই শয্যায় জায়গা হয়নি। তাঁরা কেউ মেঝেতে কেউবা বারান্দায় শুয়েবসে আছেন। যাঁদের জায়গা হয়েছে তাঁদের দুজন একসঙ্গে শয্যা ভাগাভাগি করে থাকছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, তাঁরা হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা পেয়েছেন। মাথায় আঘাত পাওয়া সবারই সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে অবস্থান করছেন।

হাসপাতালের শয্যায় মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বসেছিলেন চারুকলা অনুষদের এক শিক্ষার্থী। তিনি মাথায় ইটের আঘাত পেয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তির পর প্রথমে তাঁর মাথার রক্ত বন্ধ করা যায়নি। তাঁকে নিয়ে চিকিৎসকেরা শঙ্কায় ছিলেন। তবে চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় তাঁর রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। ওই শয্যায় শুয়ে ছিলেন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাজীব খান। তাঁর মাথায় পুলিশের ছোড়া কাঁদুনে গ্যাসের শেল লেগেছে। একইভাবে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন ফারসি ভাষার শিক্ষার্থী আশিক মাহাবুব। তাঁর মাথা, বুক ও পায়ে জখম হয়েছে। তাঁর রক্তাক্ত গেঞ্জিটা বের করে দেখালেন সহপাঠীরা।

আরও পড়ুন

হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, একজন ছাড়া কোনো আহত ছাত্র শয্যা পাননি। তিনজন মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে শুয়েবসে আছেন। তাঁদের সেবা করছে একদল সহপাঠী। একজনের কপালে ইটের বড় জখম। তাঁকে তাঁর বান্ধবী খাইয়ে দিচ্ছেন। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে কাজ করা আলেয়া বেগম জানালেন, তিনি বেওয়ারিশ রোগীদের জন্য কিছু চাদর রাখেন, সেগুলো পেতে দিয়েছেন। একজন ছাত্র বললেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্বল ও খাবার এনেছেন।

ওই ওয়ার্ডের পেয়িং বেডে অচেতন হয়ে আছেন একজন ছাত্র। তাঁর মাথা ও চোখে ইটের আঘাত লেগেছে। একই ওয়ার্ডের বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে আরেক শিক্ষার্থী নিয়ামুল নাজিমের। তাঁর মাথা ও পিঠ পুলিশের রাবার বুলেটে জর্জরিত। ওয়ার্ডের আরেক বারান্দায় আছেন মাথা ও গায়ে রাবার বুলেটের আঘাত পাওয়া শিক্ষার্থী সানাউল্লাহ। একই ওয়ার্ডের বারান্দায় বসে আছেন সাদ্দাম হোসেন। তাঁর মাথায় ইটের আঘাতে জখম। তিনি বললেন, ‘বিনোদপুরে ছোট ভাইদের কী হয়েছে দেখতে গিয়ে আমি ইটের আঘাতে আহত হই।’

আরও পড়ুন
ঢাকা–রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। আজ রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

২৫ নম্বর চক্ষু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, ছয়জন আহত শিক্ষার্থীর চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন মাহফুজুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি চশমা পরা ছিলেন। ইটের আঘাতে তাঁর চশমার কাচ ভেঙে চোখের ভেতরে ঢুকে যায়। রাতে তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দ্রুত তাঁরা সুস্থ হয়ে উঠবেন। এক শিক্ষার্থীকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ থেকে ১২ শিক্ষার্থী দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা আহত শিক্ষার্থীদের সমবেদনা জানাতে আসেন।

গুরুতর আহত অবস্থায় আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুলকে। তাঁকে রাত থেকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। আইসিইউ ইনর্চাজ আবুল হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। শুধু ভরসা ছিল, তাঁর বয়স কম। অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আজ দুপুরে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি কথা বলতে পারছেন।

রামেক হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় দুপুর পর্যন্ত ৯০ শিক্ষার্থী ভর্তি আছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন আরও অনেকে।

গত তিন দশকে তুচ্ছ ঘটনার জেরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পাঁচ-ছয়টি ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে মাঝেমধ্যে ওরিয়েন্টেশন হওয়া দরকার, যাতে কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তাহলে ক্ষয়ক্ষতিটা আর বড় হয় না।