এত করলা হয় যে লোকে বলে ‘করলা গ্রাম’

নাটোরের সিংড়ার মহেশচন্দ্রপুরের করলা বাজার
ছবি: প্রথম আলো

বাড়ির আঙিনা থেকে মাঠ, যে দিকে তাকানো যায় শুধু করলার খেত। কুয়াশাঢাকা ভোর থেকে এসব খেতে চাষিরা পরিচর্যা ও করলা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের হাটে আসতে থাকে করলাবোঝাই বড় বড় ডালি। দুপুরের আগেই বেচাকেনা শেষ হয়। দুপুর থেকে ট্রাকে, ভ্যানে করে করলা চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার আড়তদারদের কাছে।

এই চিত্র নাটোরের সিংড়া উপজেলার মহেশচন্দ্রপুর গ্রামের। ৪০ বছর ধরে এই গ্রামের শতভাগ কৃষক সবজি চাষ করে আসছেন। এর মধ্যে শুধু করলা চাষ করছেন ৯০ ভাগ কৃষক। সপ্তাহের সাত দিনই এখানে বসে করলার হাট। ব্যাপক হারে করলা চাষের কারণে গ্রামটি আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে ‘করলা গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামটির অর্ধেক সিংড়া পৌরসভার মধ্যে, বাকিটা উপজেলার কলম ইউনিয়নের মধ্যে। গ্রামটির অধিকাংশ জমি সবজি চাষের জন্য উপযোগী। তাই করলা চাষের পাশাপাশি একই জমিতে চাষিরা ৪০ বছর ধরে পটোল, কুমড়া, ঢ্যাঁড়স, বরবটি, বেগুন, মরিচ, লাউ চাষ করে আসছেন। এতে কৃষকেরা সারা বছরই জমি থেকে উপার্জন করছেন। গ্রামের মধ্যে স্থানীয় বাজারেই সবজি বেচাকেনা হয়। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারেরা আসেন সবজি  কিনতে। বছরের শুরু থেকে এপ্রিল মাস অবধি এই বাজারে শুধু করলা বিক্রি হয়। ফলে প্রান্তিক চাষিদের পরিবহন খরচ কম হয়। স্বল্প সময়ে তাঁরা তরতাজা করলা নিয়ে বাজারে আসতে পারেন এবং বিক্রি শেষে বাড়ি ফিরে যান।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, চলতি বছরে সিংড়া উপজেলার ১৯০ হেক্টর জমিতে করলার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মহেশচন্দ্রপুর গ্রামেই ১০০ হেক্টরের বেশি জমিতে করলার চাষ হয়েছে। এ বছর করলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৭০ মেট্রিক টন। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বলেছেন।

সম্প্রতি এক কুয়াশাঢাকা ভোরে মহেশচন্দ্রপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের অধিকাংশ নারী-পুরুষ, এমনকি শিশু-কিশোরেরাও বাড়ি ছেড়ে মাঠে নেমেছে। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে মাঠের অধিকাংশ জমিতে করলার খেত। নারী ও শিশু-কিশোরেরা করলার লতাপাতা সরিয়ে তরতাজা করলা তুলছেন। পুরুষেরা করলা খেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত। যাঁদের করলা তোলা শেষ হয়েছে, তাঁরা বড় বড় ডালি সাজিয়ে দ্রুত হাটের দিকে রওনা হচ্ছেন।

মহেশচন্দ্রপুর দক্ষিণ মাঠের করলা চাষি মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে করলা চাষ করতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। নিয়মিত সেচের পাশাপাশি  প্রতি সপ্তাহে করলার জমিতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়। উৎপাদন ভালো হলে এবং সঠিক দাম পাওয়া গেলে প্রতি বিঘা জমির করলা ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারেন।

মহিউদ্দিনের পাশের জমিতে করলা তুলছিলেন জাহানারা বেগম (৪৫) ও তাঁর ছেলে মাজদার হোসেন (১২)। জাহানারা বেগম বলেন, করলা তোলার কাজটা বেশির ভাগ সময় পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মায়েরাই করেন। লতাপাতা ঠিক রেখে খুব সাবধানে করলা তুলতে হয়।

সকাল সাতটার দিকে মহেশচন্দ্রপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, করলার ডালি নিয়ে প্রায় অর্ধশত চাষি দাঁড়িয়ে আছেন। পাইকারেরা দামদর করে করলা কিনতে শুরু করেছেন। আশপাশের চায়ের দোকানে লোকজনের ভিড় বাড়ছে। অনেকে করলার ডালি রেখে পাশের দোকানে গরম খিচুড়ি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

চায়ের দোকানে কথা হয় করলাচাষি সামশুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এবার প্রতি বিঘায় গড়ে ২০ মণের মতো করলা হয়েছে। শুরুতে প্রতি কেজি করলা ৬০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে, দাম কমছে। তবে প্রথম দিকে ভালো দাম পাওয়ায় উৎপাদন খরচ উঠে গেছে। এখন যা হবে, সেটাই লাভ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, মহেশচন্দ্রপুর গ্রামে ৪০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে করলা চাষ হয়ে আসছে। আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে এই গ্রাম ‘করলা গ্রাম’ বলে পরিচিতি পেয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর উপজেলায় তুলনামূলক বেশি করলা হয়েছে। তাঁরা বিষমুক্ত করলা উৎপাদনের জন্য চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছেন বলে জানালেন।