নীরবের মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন

নিহত নীরব মণ্ডল
ছবি: সংগৃহীত

কেউ টাকা নিয়ে বাড়ি করবে, কেউবা কিনবে মোবাইল, আবার কারও ইচ্ছা বাবার ঋণ শোধ করার—এমন বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণে অপহরণ করা হয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নীবর মণ্ডলকে। অপহরণকারীদের সবার বয়স ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। তাদের কেউ পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, কেউ নবম ও দশম শ্রেণিতে। সবাই নীরবের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং একই এলাকায় তাদের বাড়ি। কে নীরবকে ডেকে আনবে, কে নীরবের বাবার মুঠোফোন নম্বর জোগাড় করবে, কে আনবে দড়ি—সবই ঠিক করা ছিল আগে থেকেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও করে ওই শিশুরা।

অপহরণকারীরা নীরবের বাবা শেখর মণ্ডলের কাছে চেয়েছিল ৩০ লাখ টাকা। ১৬ সেকেন্ডের এক কলে ৫ দিনের মধ্যে টাকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। তবে কোথায় টাকা দিতে হবে, এ ব্যাপারে ওই সময় কিছু জানানো হয়নি। সবকিছু এতটাই পরিকল্পিত ছিল যে কথা বলার জন্য তারা অন্যের কাছ থেকে একটি সিমও জোগাড় করে রেখেছিল। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে খুলনা নগরের পাশে জিরো পয়েন্ট এলাকায় গিয়ে নীরবের বাবাকে ফোন করেছিল তারা। পরে ফোনটি বন্ধ করে রাখে।

তবে পুলিশের হাত থেকে রেহাই পায়নি অপরাধীরা। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত পাঁচ শিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত শুক্রবার রাতে খুলনার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২-এর বিচারক রওনক জাহানের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ওই শিশুরা।

গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে অবস্থিত গুটুদিয়া অক্রুর চন্দ্র গোলদার বান্ধব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছনের অংশের একটি পরিত্যক্ত ভবন থেকে নীরবের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে যারা অপহরণ ও খুন করেছে, তারাও ছিল একই বিদ্যালয়ের ছাত্র।

বৃহস্পতিবার রাতেই নীরবকে অপহরণ ও খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শুক্রবার দুপুরের দিকে ডুমুরিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন নীরবের মামা বিশ্বজিৎ জোয়ার্দ্দার। সন্ধ্যার দিকে ওই শিশুদের আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরে তাদের যশোরে অবস্থিত কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।  

যে কারণে টার্গেট নীরব
গুটুদিয়া পূর্ব পাড়া গ্রামে বাড়ি নীরব মণ্ডলের। বাবা শেখর মণ্ডল একজন ব্যবসায়ী। নিজে পরিশ্রম করে টাকাপয়সার মালিক হয়েছেন। প্রায় ১০ বছর আগে একতলা পাকা বাড়ি করলেও বছর দেড়েক হলো সেটিকে দ্বিতীয় তলায় রূপান্তর করেছেন। নতুন রং করা বাড়িটি ওই গ্রামের সবার নজর কাড়ে। আশপাশে এমন বাড়ি আর একটিও নেই।
পুলিশ বলছে, নীরবরা সচ্ছল হওয়ায় ওই শিশুরা নীরবকে টার্গেট করে। দেড় থেকে দুই মাস আগ থেকে তারা নীরবকে অপহরণ করার চেষ্টা করতে থাকে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সরস্বতীপূজার দিনও অপহরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তারা। পরে গত বৃহস্পতিবার ওই শিশুরা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়।

ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওই শিশুদের ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া জবানবন্দির বরাত দিয়ে বলেন, ভারতীয় ধারাবাহিক ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ দেখে ওই শিশুরা নীরবকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নীরবকে অজ্ঞান করে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু কী করে অজ্ঞান হবে, তা বুঝতে না পারায় কয়েকজন ধরাধরি করে জোর করে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। এতেই মৃত্যু হয় নীরবের। পরে তারা জিরো পয়েন্ট এলাকায় গিয়ে ফোন করে নীরবের বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে।

যেভাবে ধরা পড়ল অপরাধীরা
বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ি থেকে স্কুলে গিয়েছিল নীরব। বেলা দুইটা পর্যন্ত ক্লাসও করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন শিক্ষকেরা। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নীরবকে জীবিত পেতে গেলে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে বলে নীরবের বাবা শেখর মণ্ডলকে ফোন করে জানানো হয়। পুলিশকে যেন না জানানো হয়, এ ব্যাপারেও সতর্ক করে অপহরণকারীরা। কিন্তু  নীরবের বাবা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে ঘটনা জানান। পরে সাড়ে বিকেল চারটার দিকে থানায় গিয়ে জিডি করেন।

ওই জিডিকে ভিত্তি ধরে ফোনকলের নম্বরটি কার, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে পুলিশ। পরে দেখা যায়, নীরবের বাড়ির পাশের একজনের নম্বর সেটি। প্রায় এক মাস আগে নম্বরটি একবার ব্যবহার করা হয়েছিল। এরপর সেদিন আবার ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ তিন শিশুকে সন্দেহভাজন হিসেবে তুলে নিয়ে আসে। সঙ্গে তাদের বাবা-মাকেও আটক করে আনা হয়। কিন্তু ওই তিন শিশু ছিল খুবই শান্ত। তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও কিছুই স্বীকার করেনি। ওই রাতেই পুলিশের গাড়িতে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করানো হলেও কোনো প্রকার আতঙ্ক ছিল না তাদের মধ্যে।

পরে অন্য আরেকজনকে ধরে নিয়ে এলে সে পুলিশের কাছে সবই স্বীকার করে। এরপর একে একে মুখ খুলতে শুরু করে অন্য শিশুরা। পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী স্কুলের পেছনের একটি পরিত্যক্ত কক্ষ থেকে নীরবের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ওই শিশুদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ শিশুর তিনজনই পরিবারের একমাত্র ছেলে। বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় সবার বাবাই দিনমজুর বা কৃষক। স্বভাবে ওই শিশুদের মধ্যে কেউ কখনো উগ্রতা দেখেননি।

আরও পড়ুন

বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, ঘটনার দিন পাঁচজনের তিনজন স্কুলে আসেনি। যে দুজন এসেছিল, তারা নীরবকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাসের প্রায় ১০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে নীরব মেধাতালিকায় ছিল নবম। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য শিশুরা পড়াশোনায় খুব বেশি ভালো ছিল না। তবে তারা স্কুলে কখনো কারও সঙ্গে মারামারি করত না।

ভেঙে পড়েছেন নীরবের মা-বাবা
নীরবরা দুই ভাই, কোনো বোন নেই। ছোট নীরব। বড় ভাই খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করে। বাবা শেখর মণ্ডল ব্যবসায়ী আর মা গৃহিণী। নীরব নেই, এটি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তার মা সাথী মণ্ডল। ঘটনার পর থেকে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। খাওয়াদাওয়াও একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছেন।

নীরব মণ্ডলের বাবা শেখর মণ্ডল
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল বেলা দেড়টার দিকে নীরবদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা সাথী মণ্ডল ঘুমিয়ে আছেন। নীরবের বাবা বাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

শেখর মণ্ডল বলেন, নীরবের মৃত্যুর ঘটনায় তার মা একেবারে ভেঙে পড়েছেন। এখন একটু ঘুমিয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যার পর নীরবের লাশ তাঁদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। রাতেই লাশের সৎকার করা হয়। তিনি বলেন, ‘কী থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না। নীরবের মতো একটি শান্ত স্বভাবের ছেলেকেও বিনা অপরাধে জীবন দিতে হলো। যারা তাকে মেরেছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’