পারিবারিক কলহের জেরে দুই সন্তানকে নিয়ে আত্মহত্যা করেন মা, পরিবারের দাবি

সুমির নিহত হওয়ার খবর পেয়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন গা ঢাকা দিয়েছেন। আজ শনিবার সকালে পাটগ্রাম উপজেলার পাটগ্রাম ইউনিয়নের ধবলসুতী (রহমানপুর) গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

প্রায় ১০ বছর আগে রাজমিস্ত্রি রাশেদুজ্জামানের (৩৫) সঙ্গে সুমি আক্তারের (২৭) বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে এক মেয়ে ও ছেলে আছে। তবে রাশেদুজ্জামান আর সুমি আক্তারের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। স্বামীর সঙ্গেই ঝগড়া লেগেই থাকত। সুমির পরিবারের লোকজনের দাবি, সুমির স্বামী ও শাশুড়ি তাঁকে প্রায় শারীরিক নির্যাতনও করতেন। পারিবারিক কলহ আর নির্যাতন সইতে না পেরে সুমি তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করছেন তাঁরা। সুমির প্রতিবেশী ও গ্রামের বাসিন্দারাও একই ধরনের কথা বলেছেন।

গতকাল শুক্রবার সকালে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের দর্জিটারি রেলগেট এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন সুমি আক্তার, তাঁর মেয়ে তাসমিরা তাবাসুম (৮) ও তৌহিদ (৩)। সুমি হাতীবান্ধা উপজেলার টংভাঙ্গা ইউনিয়নের বাসিন্দা আজিজুল ইসলামের মেয়ে। সুমির স্বামী রাশেদুজ্জামান লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার পাটগ্রাম ইউনিয়নের ধবলসুতী (রহমানপুর) গ্রামের বাসিন্দা। এ ঘটনায় গতকাল রাতে নিহত সুমির বাবা আজিজুল ইসলাম বাদী হয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে লালমনিরহাট রেলওয়ে থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলায় রাশেদুজ্জামানসহ দুজনকে আসামি করা হয়েছে। পরে গতকাল রাতেই পুলিশ রাশেদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছে।

আজ শনিবার সকালে রাশেদুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। সুমির নিহত হওয়ার খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন গা ঢাকা দিয়েছেন। ওই বাড়িতে এখন তালা ঝুলছে। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাশেদুজ্জামানের নানার পরিবার স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। রাশেদুজ্জামানের বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মা রাশেদা বেগমকে নিয়ে তিনি নানার জমিতে বসবাস করেন।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার ছয়জন বাসিন্দা বলেন, রাশেদুজ্জামান ও রাশেদা বেগমের সঙ্গে সুমির প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। তাঁরা সুমিকে মারধরও করতেন। তাঁদের ধারণা, পারিবারিক কলহ আর নির্যাতন সইতে না পেরে সুমি তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

গ্রামের লোকজনের সঙ্গে রাশেদুজ্জামানের পরিবারের খুব একটা মেলামেশা ছিল না বলে জানা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাশেদুজ্জামানের বাড়িতে কেউ যাতায়াতও করতেন না। কথায়–কথায় ওই পরিবারের লোকজন মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করতেন বলে গ্রামের লোকজন তাঁদের এড়িয়ে চলতেন।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের দর্জিটারি রেলগেট এলাকায় রেললাইনে দুর্ঘটনাটি ঘটে
ছবি: সংগৃহীত

গতকাল সকালে রাশেদুজ্জামান বাড়ি থেকে বের হয়ে কাজে যান। এর কিছু সময় পর সুমি তাঁর ছেলে–মেয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আলেমা খাতুন বলেন, সুমি আক্তার দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে বুড়িমারী স্থলবন্দর রেলস্টেশনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এ সময় পাটগ্রাম রেলস্টেশনের দিক থেকে ট্রেনটি এসে তাঁদের ধাক্কা দেয়। এতে সুমি ও তাঁর মেয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে লাইনের দুই ধারে পড়ে যান। আর ছেলেটি ছিটকে পড়ে যায়। এর আগে একটি অটোরিকশায় চড়ে সুমি ছেলে–মেয়ে নিয়ে ওই এলাকায় আসেন।

সুমির মামা ফজলুর রহমান বলেন, সাংসারিক ছোটখাটো বিষয় নিয়ে রাশেদুজ্জামান ও তাঁর মা রাশেদা বেগম প্রায়ই সুমিকে মারধর করতেন। এসব নির্যাতন সইতে না পেরে সুমি একাধিকবার বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। পরে আবার পারিবারিক সমঝোতা করে সুমিকে ফিরিয়ে নিয়ে যান রাশেদুজ্জামান। কিন্তু সুমির ওপর নির্যাতন কখনোই বন্ধ হয়নি। এসব নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে সুমি তাঁর ছেলে–মেয়ে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

লালমনিরহাট রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আলী বলেন, আজ নিহত সুমির লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মামলার অন্য আসামিকে ধরতে পুলিশি অভিযান চলছে।

পাটগ্রামের ওসি ওমর ফারুক বলেন, গ্রেপ্তার রাশেদুজ্জামানকে আজ লালমনিরহাট আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।