ইকবালের খেতের মাচায় ঝুলছে হলুদ, সবুজ আর কালো তরমুজ

খেতে সারি সারি মাচায় নানান রঙের সুপুষ্ট তরমুজ ঝুলে আছে। সেখানে পরিচর্যায় ব্যস্ত তরুণ কৃষক ইকবাল হোসেন। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মসজিদিয়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

খাদ্যপণ্য বিপণন আর প্রসাধনীর ব্যবসায় লোকসান গুনে হতাশ ইকবাল হোসেন (৩৭) স্থির করেছিলেন, প্রবাসে যাবেন ভাগ্য বদলাতে। কিন্তু ছেলে দূর দেশে চলে যাবে, এটি মানতে পারেননি তাঁর মা শাহানা আক্তার। মায়ের কথায় বিদেশে না গিয়ে দিন ফেরাতে আবারও দেশেই কিছু করতে চেয়েছেন। বুঝেশুনে শেষে কৃষিতে মনোযোগ দেন ইকবাল। শুরুতে শসা চাষ করে তেমন সুবিধা করতে না পেরে হাত দেন গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে। আর প্রথমবার তরমুজ চাষ করেই দারুণ সফল হয়েছেন এই তরুণ কৃষক।

ইকবাল হোসেন মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের মসজিদিয়া গ্রামের মো. জামশেদ আলমের ছেলে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ইকবাল স্নাতকে ভর্তি হলেও নানা সংকটে তা শেষ করা হয়নি।

মঙ্গলবার বিকেলে মসজিদিয়া গ্রামে ইকবাল হোসেনের তরমুজখেতে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি মাচায় ঝুলছে শত শত তরমুজ। হলুদ, সবুজ আর কালো রঙের এমন পুষ্ট তরমুজ দেখে চোখ জুড়াবে যে কারও।

খেতেই কথা হয় তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে সব ছেড়ে কৃষি পেশায় যুক্ত হয়েছেন তিনি। প্রথমে নিজের জমিতে শসা চাষ দিয়ে শুরু করেছিলেন। তবে তাতে পুঁজি উঠলেও তেমন লাভ হয়নি সেবার। এরপর ৫০ শতকের সেই একই জমিতে উচ্চমূল্যের ফসল গ্রীষ্মকালীন তরমুজের চাষ করেন তিনি। গত ১৭ জুলাই খেতে ব্ল্যাকবেরি, ইয়েলো গোল্ড, ব্ল্যাক ডায়মন্ড ও তৃপ্তি জাতের তরমুজের বীজ বপন করেন। বৃষ্টির ধকল, ভাইরাস, বালাইদমনসহ নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন খেতের তরমুজ বিক্রির উপযোগী হয়েছে। এর মধ্যে কিছু তরমুজ বিক্রিও করেছেন তিনি। সার, কীটনাশক, বাঁশ, মালচিং পেপার, শ্রমিকসহ প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়। খেতে এখন আড়াই থেকে তিন কেজি ওজনের দুই হাজারের বেশি পাকা তরমুজ আছে। পাইকারিতে খেত থেকে নিয়ে যাওয়ার শর্তে ৭০ টাকা কেজি দরে চট্টগ্রাম শহরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে সব তরমুজ বিক্রির কথাও হয়ে গেছে। খেতের সব তরমুজ বিক্রি হলে তিন লাখ টাকা আয় হবে। এতে অন্তত দুই লাখ টাকা লাভ হবে তাঁর।

ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বাবা চাননি আমি কৃষি পেশায় যুক্ত হই। এলাকার মানুষও ভেবেছিল আমি পারব না। নানাজন নানা কথা বলেছে। দেখছি, দেশে কৃষির দ্রুত রূপান্তর ঘটছে। তাই কৃষিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সাহস করেছি। উপজেলা কৃষি কার্যালয়ও নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে আমাকে। এখন চাষাবাদের পরিসর বাড়ানোর ইচ্ছা আছে আমার।’

ইকবাল হোসেনের তরমুজখেত দেখতে এসেছিলেন স্থানীয় যুবক আলতাফ মাহমুদ (৩০)। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালেও এত ভালো তরমুজ চাষ হয়, এটি জানা ছিল না আমার। ইকবাল হোসেন প্রথম এ এলাকায় এটি দেখালেন। তাঁর খেতের তরমুজ আমি খেয়েছি। খুব স্বাদের তরমুজ। ইকবাল হোসেন সফল হওয়ায় তাঁর দেখাদেখি অন্যরাও তরমুজ চাষে আগ্রহী হবেন বলে ধারণা আমার।’

কথা হয় ইকবাল হোসেনের বাবা জামশেদ আলমের সঙ্গে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসা ছেড়ে ছেলে চাষাবাদ করবে, প্রথমে এটি মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু ওর একাগ্রতা দেখে চাষের জন্য কিছু জমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। অসময়ের তরমুজ চাষে ও সফল হয়েছে। দেখে এখন আমারও ভালো লাগছে।’

মিরসরাইয়ে ইকবাল হোসেনের তরমুজ খেত
ছবি: প্রথম আলো

মসজিদিয়া এলাকার ইকবাল হোসেনের গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষের বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর বেশ কয়েক দফা টানা ভারী বৃষ্টি হওয়ায় কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন তরমুজ ফলানোটা কঠিন ছিল। এমন দুর্যোগ মোকাবিলা করেও ইকবাল হোসেন তাঁর খেতে দারুণ তরমুজ উৎপাদন করেছেন। তাঁর খেতের তরমুজের আকারও বেশ ভালো। স্বাদেও মিষ্টি। আমরা তাঁকে বীজ, সার, কীটনাশক, মালচিং পেপার ও তথ্যসহায়তা দিয়েছি। লাভজনক গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে ইকবাল সফল হওয়ায় আমাদেরও ভালো লাগছে। এ চাষ পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা।’