সেবা–ভালোবাসায় সুস্থ হয়ে বনে ফিরছে পাঁচটি লজ্জাবতী বানর

সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠা দুটি লজ্জাবতী বানর। রোববার দুপুরে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকীছড়া বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টারে
ছবি: প্রথম আলো

বিপন্ন প্রজাতির পাঁচটি লজ্জাবতী বানর, যাদের থাকার কথা নির্জন বনের কোনো গাছের ডালে, কিন্তু ঘটনাক্রমে এরা বন থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের হাতে ধরা পড়েছে। কোনোটি আহত হয়েছে। মানুষ তাদের খাঁচায় আটকে রেখেছে। খাঁচা থেকে মুক্তি দিতে বিভিন্ন স্থান থেকে এদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকীছড়া বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টারে।

সেখানে এরা আছে বন্য প্রাণী গবেষক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্লামপ্লরিস ই ভির তত্ত্বাবধানে। বুনো পরিবেশে থাকা পাঁচটি লজ্জাবতীর মধ্যে তিনটির নাম দেওয়া হয়েছে হিমু, নীলা ও নিশাত। রেসকিউ সেন্টারে মানুষের সেবা ও ভালোবাসায় সুস্থ হয়ে সব কটি বানর বনে ফিরতে যাচ্ছে।

বন্য প্রাণী গবেষক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্লামপ্লরিস ই ভি সূত্রে জানা গেছে, রেসকিউ সেন্টারে থাকা লজ্জাবতী বানরগুলো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং বন্য প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের উদ্যোগ ও সহযোগিতায় প্রাণীগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে এরা রেসকিউ সেন্টারে আছে। পাঁচটির মধ্যে তিনটির নাম রেখেছেন প্লামপ্লরিস ই ভির বন্য প্রাণী গবেষকেরা।

হিমু নামের পুরুষ লজ্জাবতী বানরটিকে গত ৭ মে উদ্ধার করা হয়েছে ময়মনসিংহ থেকে। ওই সময় বানরটির শরীরে কিছুটা ক্ষত ছিল। এখন মোটামুটি ভালো। নীলা নামের একটি মেয়ে বানরকে গত ১৬ মে উদ্ধার করা হয়েছে কুমিল্লা থেকে। এটি এখনো পূর্ণবয়স্ক হয়নি। তবে ভালো আছে। নিশাত নামের অপর মেয়ে বানরটিকে উদ্ধার করা হয়েছে গত ৩০ মে গাজীপুর থেকে। এটিও অপ্রাপ্তবয়স্ক।

অন্য দুটির একটিকে গত ১৮ জুন উদ্ধার করা হয়েছে শ্রীমঙ্গলের আমরইলছড়া চা-বাগানের রাস্তা থেকে। এর বাম হাতে আঘাত ছিল। এখন আগের থেকে অনেকটা সেরে গেছে। অপরটিকে গত ৩১ জুলাই উদ্ধার করা হয়েছে মৌলভীবাজার শহরের ধরকাঁপন এলাকা থেকে। এটির মুখমণ্ডলের লোম পড়ে গিয়েছিল। প্লামপ্লরিস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, হয়তো খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছিল। খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে জোরাজুরি করেছে বানরটি। এতে লোমগুলো খসে পড়েছে।

শিগগিরই ট্র্যাকিং ডিভাইসসহ তিনটি লজ্জাবতী বানর বনে অবমুক্ত করা হবে জানিয়ে প্লামপ্লরিস ই ভির সঙ্গে যুক্ত বন্য প্রাণী গবেষক মো. হাসান আল রাজী বলেন, জানকীছড়ায় রাখা পাঁচটি লজ্জাবতী বানরের মধ্যে একটির হাতে আঘাতজনিত ক্ষত ছিল, যা এখন অনেকটাই সেরে উঠেছে। বন বিভাগ একটি বানর উদ্ধার করেছে, যেটির ওজন অনেক কম এবং শরীরে ক্ষত রয়েছে। ওজন কিছুটা বৃদ্ধি পেলে একে ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্য তিনটি লজ্জাবতী বানর এখন সুস্থ ও বনে ছাড়ার উপযোগী। তবে এদের টিকে থাকার সফলতা দেখার জন্য ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করা হবে।

বনের বাইরে প্রায়ই লজ্জাবতী বানর ধরা পড়া প্রসঙ্গে বন্য প্রাণী গবেষক মো. হাসান আল রাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা বেশ কিছু প্রাণী পেয়েছি, যেগুলো বাড়িতে চলে এসেছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলোকে মানুষ ধরে এনে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছিল। পোষ মানাতে ব্যর্থ হয়ে বন বিভাগ বা উদ্ধারকারী কোনো দলের শরণাপন্ন হয়। উদ্ধার হওয়া বানরের শরীর ও মুখমণ্ডলের লোমের অবস্থা দেখলে বোঝা যায় এরা দীর্ঘদিন কোনো খাঁচায় বন্দী ছিল।’

বন্য প্রাণী গবেষকেরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) লজ্জাবতী বানরকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বানরের এ প্রজাতি লাজুক বানর নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে এটিকে বেঙ্গল স্লো লরিস বা নর্থান স্লো লরিস বলে। বৈজ্ঞানিক নাম Nycticebus bengalensis. এরা বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনের বাসিন্দা।

এ বানর নিশাচর। বনের গভীরে উঁচু গাছে থাকতে পছন্দ করে। দিনে গাছের খোঁড়লে বা ঘন পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুমানোর সময় শরীরকে গোল বলের মতো করে রাখে। বিরল প্রজাতির, নিশাচর ও লাজুক হওয়ায় দিনে এদের সহজে চোখে পড়ে না। এগুলো গাছে গাছেই থাকে। সহজে মাটিতে নামে না। ধীরগতিতে চলাফেরা করে। এরা সাধারণত ফল, পাতা, উদ্ভিদের কষ বা নির্যাস ইত্যাদি খায়। মাঝেমধ্যে বড় কীটপতঙ্গ, পাখির ডিম-ছানা, সরীসৃপও খেয়ে থাকে।

প্লামপ্লরিস ই ভির তত্ত্বাবধায়ক চঞ্চল গোয়ালা প্রথম আলোকে বলেন, লজ্জাবতী বানরগুলো রেসকিউ সেন্টারে সারা দিনই ঘুমিয়ে কাটায়। এদের জিগাগাছের আঠা ও চাষ করা পোকা খাওয়ানো হয়। মাঝেমধ্যে বনের অভ্যাস ধরে রাখতে পোকামাকড়, ঘাসফড়িংসহ বিভিন্ন বুনো পোকা ধরে খাওয়ানো হয়।