আসন পরিবর্তনের কারণে বেকায়দায় পড়তে পারেন মেনন

রাশেদ খান মেনন
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেননের আসন আবার পরিবর্তিত হলো। গত বুধবার তাঁকে বরিশাল-৩ আসনে ১৪–দলীয় জোট ছাড় দিলেও গতকাল শুক্রবার রাতে আকস্মিক তা পরিবর্তন করে বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে তাঁকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। হঠাৎ তাঁকে এখানে প্রার্থী করায় আওয়ামী লীগ ছাড়াও তাঁর নিজের দল ওয়ার্কার্স পার্টির স্থানীয় নেতারাও অস্বস্তিতে আছেন।

ওয়ার্কার্স পার্টির স্থানীয় একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা বিব্রত ও চিন্তিত। কারণ, এই আসনের দুই উপজেলা উজিরপুর ও বানারীপাড়ায় দলের সাংগঠনিক ভিত্তি খুব একটা শক্ত নয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এখানে আন্তরিকভাবে কাজ করবে—এমন ভরসাও নেই। আর রাশেদ খান মেনন নিজে বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদি) আসন থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। এই আসন তাঁর জন্য সুবিধাজনক ছিল। এখন কী হিসাব করে জোট এমন সিদ্ধান্ত নিল, তাঁরা তা বুঝতে পারছেন না।

রাশেদ খান মেনন ঢাকা-৮ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। তবে এবার এই আসনে আওয়ামী লীগ দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মেনন বরিশাল-২ ও বরিশাল-৩ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। নিজের জন্মস্থান হলেও তিনি গত ২৮ বছর এই এলাকা থেকে নির্বাচনে অংশ নেননি। ১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন বাবুগঞ্জ ও উজিরপুর নিয়ে গঠিত বরিশাল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান তিনি।

ওয়ার্কার্স পাটির স্থানীয় নেতারা বলছেন, ১৪–দলীয় জোট গত বুধবার বরিশাল-৩ আসনে রাশেদ খান মেননকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়। কিন্তু ওই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। তিনি ২০১৮ সালে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে এই আসনে জয়ী হয়েছিলেন। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ টিপু সুলতান মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় হয়েছিলেন।

দলীয় সূত্র জানায়, বরিশাল-৩ আসনে জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থান থাকার পাশাপাশি এই আসনে মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতিকুর রহমান। ফলে এই আসন রাশেদ খান মেননের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে সুবিধা ছিল যে তাঁর জন্মস্থান বাবুগঞ্জ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাশেদ খান মেননকে বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে প্রার্থী হিসেবে ছাড় দিয়েছে ১৪–দলীয় জোট। এতে তিনি আরও কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়বেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারাও এমনটাই মনে করছেন।

আরও পড়ুন

জেলা ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক শেখ টিপু সুলতান আজ শনিবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে যে আমাদেরও উদ্বেগ নেই, তা নয়। রাশেদ খান মেনন নিজেও চাননি এখানে নির্বাচন করতে। তিনি বরিশাল-৩ আসনেই প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে স্বস্তি বোধ করছিলেন।’

বরিশাল-২ আসনে এবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুস। ইউনুস বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। রাশেদ খান মেনন এবার এই আসনে ১৪ দলের প্রার্থী মনোনীত হওয়ায় তালুকদার মো. ইউনুসের আর নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকল না।

উজিরপুর ও বানারীপাড়া উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, বরিশাল-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মো. শাহেল আলমকে এখানে এবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। মনোনয়ন পেয়েছিলেন তালুকদার মো. ইউনুস। কিন্তু গতকাল রাতে হঠাৎ এই আসনে রাশেদ খান মেনন ১৪-দলীয় জোটের মনোনয়ন পাওয়ায় হিসাব-নিকাশ জটিল হয়ে গেছে। এখানে তালুকদার ইউনুসের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা খুব ভালোভাবে নেননি। আওয়ামী লীগের দুজন শক্তিশালী প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মাঠে নামায় দলীয় নেতা-কর্মীরাও বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়তে পারেন।

বানারীপাড়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তালুকদার ইউনুস একজন সজ্জন ব্যক্তি। দলের নেতা-কর্মীরা তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ায় সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি জয়ী হতেন। এখন সবার মন ভেঙে গেছে।

বরিশাল-২ আসনে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম ওরফে মণি এবং উপজেলা কমিটির সদস্য শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতি ফাইয়াজুল হক ওরফে রাজু। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে বরিশাল মহানগর জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব ইকবাল হোসেন ওরফে তাপস ও রঞ্জিত কুমার বাড়ৈ মাঠে নেমেছেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষে সংগীতশিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাস মাঠে আছেন।

বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আকতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তালুকদার ইউনুসকে ছাড়া এখানে দলের নেতা-কর্মীরা অন্য কাউকে প্রার্থী হিসেবে মেনে নেবে না। নেতা-কর্মীরা এমন সিদ্ধান্তে অটল।

২০০৩ সালে বিএনপি জোট সরকারের আমলে উজিরপুর উপজেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বাবু লাল শীল খুন হন। ওই হত্যা মামলায় উজিরপুর উপজেলা শ্রমিক লীগের বর্তমান সভাপতি শিপন মোল্লা, উপজেলা যুবলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হেমায়েত উদ্দীন, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আজিজ সিকদারসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। পরে তাঁরা ওই মামলা থেকে খালাস পান। এ নিয়ে উজিরপুরে ওয়ার্কার্স পাটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পুরোনো বিরোধ আছে।

এর আগে ১৯৯২ সালের ১৭ আগস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির তোপখানা কার্যালয়ের সামনে রাশেদ খান মেননকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলে তিনি আহত হন। ওই ঘটনায় বরিশাল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম ওরফে মণিকে সন্দেহজনক আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ওই সময় বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেন। মনিরুল ইসলাম ১৯৮৬ সালে তৎকালীন পিরোজপুর-২ (স্বরূপকাঠি-বানারীপাড়া) আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এই দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ কারণে মনিরুলের সঙ্গে মেননের পুরোনো বিরোধ তো আছেই; আওয়ামী লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল ইসলাম ও ফাইয়াজুল হক শেষ সময়ে মেননকে ঠেকাতে এককাট্টা হলেও হতে পারেন।

বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাওলাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রার্থী পরিবর্তন করার বিষয়টি দলীয় নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারছে না। তা ছাড়া দলীয় হাইকমান্ড থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে শিথিলতা আছে, সেখানে দলীয় নেতা-কর্মীরা অন্য কারও সমর্থন করলে আমরা তো তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।’