লিচুবাগানেই বাঁধা পড়েছে জীবন
মৌসুমের শুরুতে লিচুগাছে মুকুল ধরার পরপরই তাঁরা চলে আসেন এখানে। বাগানে ঘুরে ঘুরে মুকুল দেখেন, আর লিচুর ফলন নিয়ে অনুমান করেন।
গোবিন্দনগর—ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার লিচুগ্রাম নামে পরিচিত। কাঁচা রাস্তার দুই পাশে সারি সারি লিচুগাছ। দূর থেকে তাকালে চোখে পড়ে ছোপ ছোপ লাল। সবুজের মধ্যে যেন সিঁদুরের ফোঁটা। এ সিঁদুরের ফোটা মানে পাকা টসটসে লিচু। চারদিকের নীরবতা ভাঙে ‘ফট ফট’ শব্দে। কানে আসে ‘জীবন হইল ইটের ভাটা/ ধিকি ধিকি জ্বলে রে/ সুখ যে আছে এই জীবনে/ কোন পাগলে বলে রে…’ গানের সুর।
লিচুবাগানে ছোট্ট একটি পলিথিনের ছাপরা। সেখান থেকেই ভেসে আসছে এই সুর। সেখানে খালি গলায় একজন গান ধরেছেন, অন্যজন রান্নার পাতিলে চাটি মেরে তাল দিচ্ছেন। কাছে গিয়ে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।
একজনের নাম আল মামুন (৪৭), অন্যজন যুবায়ের হোসেন (৩৩)। দুজনের বাড়িই নাটোরের গুরুদাসপুরে। গতকাল শনিবার দুপুরে গোবিন্দনগরের একটি লিচুবাগানে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, মৌসুমের শুরুতে লিচুগাছে মুকুল ধরার পরপরই তাঁরা চলে আসেন এখানে। বাগানে ঘুরে ঘুরে মুকুল দেখেন, আর লিচুর ফলন নিয়ে অনুমান করেন। পছন্দ হলে বাগানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তি করেন। পরে সেখানে অস্থায়ী ‘ডেরা’ গড়েন, আর বাগানের পরিচর্যার কাজ শুরু করেন। ‘ডেরা’ মানে পলিথিনের ছাপরা। লিচু পাকলে পাড়ার পর তা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। লিচুর এই মৌসুমে মাস কয়েক বাগানেই কাটে তাঁদের।
আল মামুন জানালেন, বছর বিশেক আগে চাচার সঙ্গে এখানে এসেছিলেন। সেবার একটা বাগানের লিচু কিনেছিলেন তাঁর চাচা। সেবার ব্যবসা ভালো হয়েছিল। সেই থেকেই তাঁর লিচু ব্যবসার শুরু।
আল মামুন বললেন, এই ব্যবসা অনেকটা জোয়ার-ভাটার মতো। কোনো বছর লাভ ভালো, আবার কোনো বছর লোকসান। গত বছর বাগান কিনে শিলাবৃষ্টি আর ঝড়ে আট লাখ টাকা লোকসান দিয়েছিলেন। আর এ বছর তাপে অনেক লিচুর গুটি ঝরে গেছে। যেটুকু আছে, তা–ও আবার ফেটে গেছে। তবে বাজারদর এবার ভালো। তাই লাভ মন্দ হবে না। বলতে বলতে ছাপরার পাশ থেকে বাঁশের তৈরি যন্ত্রে হাত দিয়ে চেপে ধরেন মামুন। অমনি ফট ফট শব্দ করে ওঠে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মামুন বললেন, এটি ফটফটিয়া। বাগান থেকে বাদুড় তাড়াতে কাজ করে। লিচুবাগানের মালিকদের বড় শত্রু এই বাদুড়। ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় আসে, লিচু খায়, আর নষ্ট করে। পাশ থেকে যুবায়ের একটি দড়ি ধরে টান দিলেন, অমনি শুরু হলো টিন পেটার শব্দ। যুবায়ের বললেন, এটি টিনবাঁধ। এটাও বাদুড় তাড়াতে বেশ কাজের।
বাদুড় ছাড়াও আছে লিচু চুরির ভয়। এলাকার ছেলেরা দলবেঁধে বাগানে ঢুকে লিচু চুরি করে পালায়। অনেক সময় তাদের সঙ্গে ঝামেলাও বাধে। আল মামুন বললেন, ‘লিচুতেই আমাদের জীবন বাঁধা। সংসার ছেড়ে এখানে পড়ে আছি।’
পাশে পলিথিনের ছাপরায় দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত ইমরান আলী (৬১)। মুরগির তরকারি ঘ্রাণ এসে নাকে ধাক্কা দিল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রাঁধছেন, ভাই?’
কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তে ইমরান ছোট্ট করে বললেন, ব্রয়লার (মুরগি)।
এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আজ (গতকাল) ব্রয়লার আর সবজিতেই খাওয়া হবে।
প্রতিদিনই কী এমনই খান—জানতে চাইলে ইমরান বলেন, ‘সপ্তাহের চার-পাঁচদিন ভাজি-ভর্তা দিয়ে খাওয়া সেরে নেই। আর একদিন ভালো-মন্দ খাই। খাওয়ার পেছনে সব খরচ করলে হবে নাকি? টাকা জমাইতে হবে না? দুইটা টাকার জন্যই তো এই কষ্ট!’
ইমরানের দুই মেয়ে। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে স্ত্রী একা। মনটা খারাপ হলে মুঠোফোনে স্ত্রী, মেয়ে ও নাতিদের সঙ্গে কথা বলেন। ইমরান বললেন, ‘সালেহা (তাঁর স্ত্রী) অসুস্থ। ভিডিওকলে তার সঙ্গে কথা বলছিলাম। এখানে থাকতে মনটা আর মানে না। কিন্তু উপায়তো নাই। এই লিচুবাগান ফেলে তো যাওয়া যাবে না।’
এ বছর এলাকার ১১টি লিচুবাগান কিনেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আজহারুল ইসলাম। এসব বাগানে গোলাপী, বোম্বাই, মাদরাজি, আর চায়না থ্রি লিচুর গাছ রয়েছে। সেসব লিচু দেখভাল করতে এলাকা থেকে ৪৫ জন লোক এনেছেন। তাঁদের মাস তিন-চারেক এখানে থাকতে হয়।
আজহারুল বললেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যে সব লিচু ভাঙা শেষ হবে। আমরাও বাড়ি ফিরে যাব। কয়েক মাস কাটানোর পর আগামী মৌসুমের জন্য আবার এখানে ফিরে আসব। লিচু নিয়ে শুরু হবে ব্যস্ততা।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, জেলায় ৭০৫ হেক্টর জমিতে ২৫৬টি লিচুর বাগান আছে। এসব বাগানের মালিকেরা গাছে মুকুল আসার পরপরই ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। ব্যবসায়ীর লোকজন এখানে এসে থাকেন, লিচুর পরিচর্যা করেন। বাজারে ফল বেচা শেষে বাড়ি ফিরে যান তাঁরা।