দুর্ঘটনায় পা হারানো মিফতাহুলের লেখাপড়া চলছে খুঁড়িয়ে
ভ্যানে করে স্কুলে যাওয়ার পথে পিকআপের চাপায় ডান পা হারান মিফতাহুল জান্নাত (১৮)। এর পর থেকে অন্য পায়ের ওপর ভর করে চলছে তাঁর জীবনসংগ্রাম। এ অবস্থাতেও থেমে যাননি, চালিয়ে যাচ্ছেন পড়াশোনা। পা হারিয়ে হাসপাতালে শুয়ে পেয়েছিলেন ট্যালেন্টপুলে প্রাথমিকের বৃত্তি পাওয়ার খবর। জিপিএ-৫ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন গত বছরের (২০২৪) এসএসসি পরীক্ষাতেও। এক পা নিয়েই মিফতাহুল জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে চান, হতে চান চিকিৎসক। তবে একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবার সীমিত আয়ের কারণে পড়াশোনায় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছে পরিবার।
মিফতাহুল জান্নাত যশোরের শার্শা উপজেলার দক্ষিণ বুরুজবাগান গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে। গত বছর তিনি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান। বর্তমানে উপজেলার নাভারণ ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন অদম্য এই তরুণী। মিফতাহুল জান্নাত বলেন, ‘আমি ডাক্তার হতে চাই। সেভাবেই আমি লেখাপাড়া করছি। যতই কষ্ট হোক ভালো করে লেখাপড়া করে আমি ডাক্তার হব।’
মিফতাহুলের পরিবার জানায়, তাঁর পড়াশোনার এই সফর মোটেই সহজ ছিল না। ২০১৯ সালের ২০ মার্চ সকালে ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে করে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। যশোর-বেনাপোল সড়কের পাশে বিদ্যালয়ের ফটকের সামনে ভ্যানটিকে ধাক্কা দেয় উল্টো দিক থেকে আসা বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পিকআপ ভ্যান। এতে মিফতাহুল মহাসড়কের ওপর ছিটকে পড়লে পিকআপ তাঁর শরীরের ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে তাঁর ডান পা ও ডান হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে চিকিৎসকেরা তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দেন। দুর্ঘটনার চার দিন পর ২৪ মার্চ প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। মিফতাহুল যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডের একটি শয্যায় শুয়ে পেয়েছিলেন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার খবর।
স্বজনেরা বলেন, মিফতাহুল জান্নাতের বাবা রফিকুল ইসলাম (৪১) শার্শার নাভারণ কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক। দুর্ঘটনার পর নিজেদের জমি বিক্রি কিরে মেয়েকে নিয়ে যান ভারতের ভেলরে। সেখানে তাঁর কৃত্রিম পা লাগানো হয়। এতে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকার মতো ব্যয় হলে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েন। রফিকুলের সম্পদ বলতে সাড়ে পাঁচ শতাংশ জমি। এই জমির ওপর তিন কক্ষের একটি দালানে তিনি সপরিবারে বসবাস করছেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। মিফতাহুল বড় এবং ছেলে মুন্তাকিম রাফি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগের ছাত্র। কিন্ডারগার্টেনের বেতন ও বাড়িতে টিউশনি করে রফিকুলের মাসে ২০ হাজার টাকার মতো আয় হয়। মিফতাহুলের মা মুসলিমা খাতুন গৃহিণী। তিনি বাড়িতে দুটি গাভি এবং দুটি বাছুর পালন করছেন। এ ছাড়া পরিবারটির আর কোনো আয়ের উৎস নেই। এই আয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করান তাঁরা।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মিফতাহুলের কষ্টটা আমি বুঝি। আমার খুব সামান্য আয়। তাই দিয়ে ওকে আমি লেখাপড়া করিয়ে যাচ্ছি। আমার আয়ের অর্ধেক টাকা ওর লেখাপড়ার জন্য ব্যয় হয়। মিফতাহুল ডাক্তার হতে চায়। যত কষ্টই হোক, ওকে আমি শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে যাব।’
মিফতাহুলের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে নাভারণ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল বলেন, মিফতাহুল জান্নাত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। বড় একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে সে। এরপরও দৃঢ় মনোবল নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। কলেজের পরীক্ষায়ও খুব ভালো করছে। কলেজ থেকে তাঁর বেতন নেওয়া হয় না। কলেজের শিক্ষকেরা অ্যাকাডেমিক বিষয়ে তাঁকে সহায়তা করেন।
২০২৪ সালের ১২ মে প্রথম আলোতে ‘যশোরে দুর্ঘটনায় পা হারানো মিফতাহুল পেল জিপিএ-৫’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর এক আমেরিকা প্রবাসী তাঁকে কিছু আর্থিক সহায়তা করেন।