পদ্মা নদীতে ড্রেজিং শুরুর পর রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় শুরু হয়েছে ভাঙন। নদীতে বিলীনের হাত থেকে রক্ষায় পাড়ের গাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। গত রোববার বিকেলে উপজেলার কামালদিয়াড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কয়েক শ লোক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে হাহাকার করছেন। কেউ ১০-১৫ বছর বয়সী আমগাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ ভটভটিতে করে নিয়ে যাচ্ছেন কেটে রাখা খেজুরগাছ। নারী শ্রমিকেরা জমির পেঁয়াজ তুলে নিচ্ছেন। অসহায় অবস্থায় নদীপাড়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন কেউ কেউ।

গত রোববার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী কামালদিয়াড় এলাকায় গিয়ে দেখা গেল এই চিত্র। পদ্মা নদীর ভাঙনে এই এলাকার আমবাগান থেকে শুরু করে গম, পেঁয়াজ, মসুর, শর্ষে, খেসারি, কপি ও পটোলের খেত—সবই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গত আট দিনে দেড় কিলোমিটার এলাকার ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ড্রেজিংয়ের (খনন) সময় নদীর উজানে দুটি জায়গায় স্পার নির্মাণের বালু স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখানে স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় আঘাত হানছে। এতে তীব্র নদীভাঙন শুরু হয়েছে।

এই ড্রেজিংয়ের প্রভাবে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। এই স্রোত বন্ধ করতে না পারলে এই জনপদই শেষ হয়ে যাবে।
সানিউল হক, পাকুড়িয়া গ্রামের কৃষক

স্থানীয় জমির মালিকেরা বলছেন, একটি স্পার বাঁধ আগেই কামালদিয়াড় এলাকায় নির্মাণ করা হলে এই জনপদ ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। নিরুপায় এলাকাবাসী ৭ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ‘পদ্মার তীর রক্ষার্থে প্রস্তাবিত স্থায়ী বাঁধ, স্পার (রাজশাহী টি বাঁধ ও আই বাঁধ সদৃশ) নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় আটটি প্যাকেজে পদ্মা নদী খননের জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় বাঘার আলাইপুর চকরাজাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনগর পর্যন্ত ১২ দশমিক ১ কিলোমিটার নদী খনন করা হচ্ছে। নদীর তলায় ১২০ মিটার চওড়া করে খনন করতে হবে। নভেম্বর মাস থেকে এই খননকাজ শুরু হয়েছে। মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান এলাকা পরিদর্শন করে বলেছেন, ড্রেজিংয়ের সাময়িক প্রভাবে এলাকার অনেক কৃষিজমির ক্ষতি হয়েছে।

রাজশাহী পাউবোর নির্বাহী পরিচালক সফিকুল ইসলাম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, এটা এখন নদীর মূল প্রবাহ হয়ে গেছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের দাবি, এখানে একটি স্পার এখনই নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু এখানে পানি বেশি। তাঁরা অন্য জায়গা থেকে বালু এনে স্পার নির্মাণ করার চেষ্টা করবেন। 

কামালদিয়াড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাকুড়িয়া গ্রামের ওহিদুর রহমান তাঁর বাগানের আমগাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন। তার বাগানে ৭০টি আমগাছ ছিল। এক বিঘা গম ছিল। শিষ বের হওয়ার আগেই বিলীন হয়ে গেছে। বলতে বলতেই তিনি মাথা ধরে নদীর কিনারে বসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পাশ থেকে বড় একটা মাটির খণ্ড নদীতে ভেঙে পড়ল।

ওহিদুরের বাগানের পশ্চিম পাশেই কৃষ্ণ ও সজল নামের দুই ভাইয়ের ৯ বিঘা জমি ছিল। এক বিঘা এখন অবশিষ্ট আছে। সেই জমির দক্ষিণ মাথা থেকে কিছুক্ষণ পরপর মাটি ভেঙে পড়ছে। কৃষক আবদুল খালেক এসে বললেন, তাঁর দেড় বিঘা গম আর আট কাঠা বেগুনের খেত ছিল। সবই নদীতে ভেঙে গেছে। পাকুড়িয়া গ্রামের আমিরুল ইসলামে ১৬ বিঘা জমিতে ৬০০ আমগাছ ছিল। প্রতিটি গাছের বয়স প্রায় ১৫ বছর হয়েছিল। সব ভেঙে গেছে। একই গ্রামের সানিউল হক মালিথার ১০-১২ বছর বয়সী ১০০ আমগাছ ছিল। সব গাছ কেটে সরিয়ে নিয়েছেন। সানিউল হক বললেন, ‘এই ড্রেজিংয়ের প্রভাবে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। এই স্রোত বন্ধ করতে না পারলে এই জনপদই শেষ হয়ে যাবে।’

কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ নূরুজ্জামান মণ্ডল বললেন, তাঁর ১ একর ২০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। পেঁয়াজসহ সব জমি ভেঙে গেছে। তার আর কোনো আবাদি জমি নেই। 

সাদি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম আট বছর ধরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে আম রপ্তানি করেন। তাঁর বাগানের আমগাছগুলোই এখন নদীতে ভেঙে যাচ্ছে। তিনি বলেন, পাউবো চাইলে ড্রেজার দিয়ে বালু ফেলে এখানে একটি স্পার নির্মাণ করে এই প্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারে। পদ্মার তীর রক্ষার্থে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে খননকাজ করা হচ্ছে। কিন্তু তার আগেই যদি এই জনপদ বিলীন হয়ে যায়, তাহলে এই প্রকল্পের আর কী দরকার ছিল?

সেখানেই পাওয়া গেল একটি প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের প্রতিনিধি রাজ্জাককে। তিনি বললেন, নদীর এই অংশের মাটির মালিক জেলা প্রশাসক। এখানে তাঁদের কিছু করার নেই।

 জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল প্রথম আলোকে বলেন, বাঘাকে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য পাউবো মোট ৭২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটা একটা কারিগরি ব্যাপার। এটা দেখার জন্য তিনি পাউবোকে নির্দেশনা দিয়েছেন।