হাওরপারের নতুন দৃশ্য, খেজুরগাছে রসের হাঁড়ি
‘খেজুরগাছে হাঁড়ি বাঁধো মন/ নইলে রস গড়িয়ে গোড়া পচে অকালে হবে মরণ’ গানটি যেন কানের কাছে বেজে চলেছে। হাওরপারে গা ছুঁয়ে, প্রতিবেশী হয়ে হেলানো শরীরে দাঁড়িয়ে আছে দুই শতাধিক খেজুরগাছ। এসব গাছের গলায় মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিচ্ছিলেন কয়েকজন ‘গাছি’। হাওরপারের জনপদে ‘গাছিদের’ খেজুরগাছে ওঠা, গাছে ঝুলে ঝুলে হাঁড়ি বাঁধার এ দৃশ্য নতুন। এ যেন এক নতুন আয়োজন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ইউনিয়নের ছিকরাইলে হাইল হাওরপারের একটি মাছের খামারে বেড়ে উঠেছে এসব খেজুরগাছ। শখের খেজুরগাছে এই শীতে ঝুলছে ছোট-বড় রসের হাঁড়ি। টাটকা খেজুর রসের টানে সাতসকালে খেজুরবাগানে ভিড় করছেন নানা শ্রেণির মানুষ।
রোববার দুপুরে হাইল হাওরপারের খেজুরবাগানে গিয়ে দেখা গেল, বিশাল পুকুরপাড়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো খেজুরগাছ। সকালের কুয়াশা তখন কেটে গেছে। চারদিকে ঝকমকে রোদ উঠেছে। হাইল হাওরের পাকা সড়ক ধরে ছিকরাইলে যাওয়ার পথে গ্রামের গাছপালা, খোলা মাঠ রোদে ভাসছিল। ছিকরাইলে এআরএন অ্যাগ্রো লিমিটেডের মাছের খামারটি তখন রোদে আরও বেশি উজ্জ্বল। শীতের সময়ে রোদ থেকে ওম কুড়িয়ে ফুরফুরে হয়ে উঠছে খেজুরগাছগুলো।
মাথার ওপর তখন শরতের মতো নীল আকাশ, সাদা মেঘের পাল ভেসে বেড়াচ্ছে। একটি পরিযায়ী পাখির ঝাঁক এদিক-ওদিকে ওড়াউড়ি করছে। পুকুরপাড়ের খেজুরগাছের কোনোটির গলার কাছে ছাল তোলা। সেখানকার হলদে ত্বক রোদে ঝলসে আছে। সেই গাছের গলায় ঝোলানো হয়েছে মেটে রঙের মাটির হাঁড়ি। হাঁড়িগুলো জাল দিয়ে ঢেকে রাখা, যাতে রাতে বাদুড়সহ অন্য কোনো প্রাণী রস খেতে না পারে।
তিনজন ‘গাছি’ তখন গাছ বেয়ে রসের হাঁড়ি বাঁধার কাজ করছিলেন। ‘গাছিরা’ খেজুরগাছের ওপরের দিকে নির্দিষ্ট স্থানটি বাটালি দিয়ে ছেঁচেকেটে হাঁড়ি বাঁধছিলেন। এক-দুই ফোঁটা করে সেই হাঁড়িতে রাতভর রস জমবে। ভোরে শুরু হবে রস তোলার কাজ। রসের টানে অনেক মানুষ ছুটে আসেন এই হাঁড়ির কাছে। হাইল হাওরের সকালের নির্জনতা তখন রসের আহ্লাদে ভেঙে পড়ে।
গাছিদের একজন মুজিবুর রহমান, বাড়ি রাজশাহীতে। গাছে হাঁড়ি বাঁধার কাজে তাঁর সঙ্গে আছেন একই এলাকার কলিম উদ্দিন ও আফজাল হোসেন। তাঁরা দুই বছর ধরে শীতে এই খেজুরবাগানে কাজ করতে আসেন। মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ছোটকাল থেকে খেজুরগাছ লাগাই, রস সংগ্রহ করি। কাজ করতে করতে কীভাবে রস সংগ্রহ করতে হয়, শিখেছি। আমার বাপও গাছ লাগাইছে, দাদাও লাগাইছে।’ তিনি বলেন, গতবার থেকে তাঁরা এখানে (ছিকরাইলে) আসছেন। কার্তিক মাসের শুরুতে এসেছেন। বাটালি দিয়ে গাছ পরিষ্কার করার পর হাঁড়ি বাঁধার কাজ করেন।
গাছি, ইজারাদার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আতাউর রহমান নামের এক ব্যক্তি এআরএন অ্যাগ্রো লিমিটেড মাছের খামারের মালিক। তিন বছর ধরে আতাউরের কাছ থেকে খামারটি মাছ চাষের জন্য ইজারা নিয়েছেন শেরপুরের ইউসুফ হাসান। ইজারা নেওয়ার পরই খেজুরগাছগুলো তাঁর নজরে পড়ে। রস সংগ্রহের ধারণাটি মাথায় আসে। খামারের মালিক শখ করেই খেজুরগাছগুলো লাগিয়েছিলেন। বয়স ১০-২০ বছর। মৌলভীবাজার অঞ্চলে খেজুরগাছের খুব একটা দেখা মেলে না। বিচ্ছিন্নভাবে কারও বাড়িতে, সড়কের পাশে দু-একটা খেজুরগাছের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু একসঙ্গে এত খেজুরগাছ নেই। ইজারাদার খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের উদ্যোগ নেন।
গত বছর খামার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাবনার আবু সাঈদ তিনজন গাছিকে নিয়ে আসেন। গত বছর রস খুব বেশি পাওয়া যায়নি। ইজারাদার রস সংগ্রহ করতে যে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তা ওঠেনি। তবে এবার রস ভালো পাওয়া যাচ্ছে। রসের টানে ভোরের আলো ফোটার সময় অনেক মানুষ মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়িতে বাগানে আসছেন। সকাল ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে রস তোলা, বিক্রি সব শেষ হয়ে যায়। একটা গাছে আধা লিটার থেকে দুই লিটার পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ১২০-১৩০ লিটার রস মেলে। প্রতি লিটার ১০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সকাল ১০টার দিকে শুরু হয় ‘গাছিদের’ গাছে হাঁড়ি বাঁধার কাজ। চলে বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। এখানে প্রায় দুই শতাধিক ছোট-বড় খেজুরগাছ আছে। প্রতিদিন দেড় শতাধিক গাছ কেটে হাঁড়ি বাঁধা হয়।
গাছি আফজাল হোসেন গাছে হাঁড়ি বাঁধতে বাঁধতে বলেন, ‘ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি। চা-পান খাই। তারপর গাছে উঠি। লোকজন আসে, রস খায়, কেউ নিয়ে যায়। কেউ শখ করে শুধু ছবি তোলে।’ গাছি কলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা তো মালিককে চিনি না। আবু সাঈদ আমাদের সঙ্গে পরিচিত হইছে। সে–ই আমাদের এখানে নিয়ে আসছে। আমরা রসের ব্যাপারে খুব সতর্ক আছি। হাঁড়িতে নেট দিই। দুজন নৈশপ্রহরী আছে, তারা বাদুড় খেদায়।’
গাছিরা জানান, তাঁরা বেতনভোগী লোক। তাঁদের খাওয়দাওয়া, তেল-সাবান—সব মালিকের। মাসে প্রত্যেকের বেতন ২৫ হাজার টাকা। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহ চলবে।
খামার-সংশ্লিষ্ট আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাছে রসের উৎপাদন তুলনামূলক কম। রসের জন্য আলাদা পরিবেশ, আবহাওয়া ও মাটি লাগে। এই এলাকা (মৌলভীবাজার) খেজুরের রসের জন্য নয়। শীত কম। শীত বেশি হলে রস ভালো হয়। আমরা খেজুরের গুড় করতে চাই, কিন্তু রসের চাহিদা বেশি হওয়ায় গুড় করা হচ্ছে না।’
ইজারাদার ইউছুফ হাসান বলেন, ‘খামারটি তিন বছরের জন্য লিজ নিছি। গতবার থেকে রস সংগ্রহ শুরু করি। তবে গতবার গাছ সাফাই করতে সময় লাগছে। গতবার ঘাটতি হয়েছে। এবার রস পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি, গতবারের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারব।’