অতিরিক্ত সেচমূল্যে চাপে কৃষক

ময়মন‌সিংহের হালুয়াঘাট উপ‌জেলার কৈচাপুর ইউনিয়‌নে সে‌চে অতি‌রিক্ত টাকা আদা‌য়ের অভিযোগ উঠে‌ছে নলকূপের মালিকদের বিরুদ্ধে। কৈচাপুরের কড়ইকুড়া গ্রা‌মেছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার একটি ইউনিয়নে নলকূপের মালিকেরা সেচের নির্ধারিত মূল্যের বেশি অর্থ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন বোরো ধানচাষিরা। কৃষকেরা বলছেন, বেশি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে খেতে সেচ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভয়ে প্রতিবাদও করছেন না তাঁরা। সেচের অতিরিক্ত টাকার কারণে নিশ্চিত লোকসানের আশঙ্কা করছেন অনেকে।

উপজেলা প্রশাসন, কৃষি কার্যালয়, বিএডিসি ও একাধিক কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে চলতি বোরো মৌসুমে ২২ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এসব জমিতে বিএডিসি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন নলকূপের মাধ্যমে সেচকাজ পরিচালিত হয়ে আসছে। উপজেলার কৈচাপুর ইউনিয়নে প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এখানে ৩০ থেকে ৪০টি গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে কয়েকটি বিএডিসি ও অধিকাংশ ব্যক্তিমালিকাধীন নলকূপ রয়েছে। এই নলকূপের মাধ্যমে কৃষকেরা তাঁদের বোরো ফসলে সেচ দিচ্ছেন।

এখানে বিদ্যুতের খরচ বেশি হয়। তাই একরপ্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা সেচ বাবদ নেওয়া হয়।
রিয়াজ উদ্দিন, নলকূপের মালিক

১ জানুয়ারি উপজেলা সেচ কমিটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বোরো মৌসুমে উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে ভূবনকুড়া, জুগলী, কৈচাপুর, হালুয়াঘাট ও গাজিরভিটা ইউনিয়নে গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচমূল্য একরপ্রতি ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। বাকি সাতটি ইউনিয়নে একরপ্রতি ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত টাকার বেশি সেচমূল্য নেওয়া হলে নলকূপমালিকের লাইসেন্স বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে উপজেলা সেচ কমিটির মাধ্যমে ইউনিয়নভিত্তিক সেচমূল একরপ্রতি ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগে সততা পাওয়া গেলে অবশ্যই সেচ কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কিন্তু কৈচাপুর ইউনিয়নে গভীর ও অগভীর নলকূপ মালিকেরা সম্মিলিতভাবে একরপ্রতি জমিতে সেচ দিতে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অতিরিক্ত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সেচ দেওয়া হবে না বলে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। কৃষকেরা নিরুপায় হয়ে নলকূপের মালিকদের সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অতিরিক্ত সেচ খরচের ফলে ফসল ঘরে কোনো লাভের মুখ দেখবেন না বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

গত রোববার কৈচাপুর ইউনিয়নের কড়ইকান্দা, নগরিয়াপাড়া, ফকিরপাড়া ও রুহিপাগারিয়া জোকাবিলেরকান্দা গ্রাম ঘুরে কৃষকদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। একাধিক কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁরা কৃষিকাজ করে সংসার চালান। নলকূপের মালিকদের অতিরিক্তি টাকা দাবি করায় তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তও দিতে পারছেন না। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, ইতিমধ্যে ধারদেনা করে বোরা ধান চাষ করেছেন। যদি সেচের মালিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় তাহলে সেচ দিতে না পারলে পানির অভাবে খেত শুকিয়ে মরে যাবে। ফলে কেউ জোরেশোরে প্রতিবাদ করার সাহসও পাচ্ছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শতে কড়ইকুড়া গ্রামের একজন কৃষক বলেন, তিনি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ৬ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তাঁর কাছে সেচ দিতে একরপ্রতি ৭ হাজার করে নলকূপের মালিক ৪২ হাজার টাকা দাবি করছেন। ইতিমধ্যে ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। এত টাকা যদি আবাদ খরচ হয়ে যায়, তাহলে ফসল কেটে বিক্রি করেও তো কোনো লাভ হবে না। নলকূপের মালিকদের কাছে কৃষকেরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

ফকিরপাড়া গ্রামের আরেক কৃষক বলেন, ‘দুই একর জমিতে সেচ দিতে ১২ হাজার টাকা ইতিমধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আরও ২ হাজার টাকা দাবি করছেন। প্রায় প্রায় ফোনে তাগদা দেওয়া হইতাছে। না পারতাছি কাউরে বলতে, না পারতাছি মাইনা লইতে। সরকারিভাবে এর একটা সুরাহ করলে কৃষকগর বিরাট উপকার অইতো।’

কারা সেচের অতিরিক্ত মূল্য নিচ্ছেন, এমন প্রশ্নে পাগারিয়া গ্রামের এক কৃষক বলেন, ‘নাম প্রকাশ করলে হয়তো সেচ বন্ধ কইরা দিবো।’

এ বিষয়ে জানতে কড়ইকুড়া গ্রামের অগভীর নলকূপের মালিক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, এখানে বিদ্যুতের খরচ বেশি হয়। তাই একরপ্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা সেচ বাবদ নেওয়া হয়। সরকারের নির্ধারিত মূল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে, এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।

এ বিষয়ে উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সেচ ক‌মি‌টির সভা আবিদুর রহমান ব‌লেন, ‘কৃষক‌দের পক্ষ থে‌কে আমা‌দের অবগত করা হ‌লে আইনগত ব‌্যবস্থা নেওয়া হ‌বে।’