সভাপতি–সম্পাদকের দ্বন্দ্ব

উপজেলা কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সম্পাদকের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকট।

আবদুল মোমিন ও বেগম আশানুর বিশ্বাস

সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের কোন্দল দীর্ঘদিনের। তবে কিছুদিন আগে কমিটি গঠন নিয়ে এই বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আধিপত্য বিস্তার করায় সাধারণ সম্পাদকের পক্ষের সঙ্গে নতুন করে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে বিরোধের কারণে দলের নেতা–কর্মীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এই বিরোধ আগামী জাতীয় নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে নেতা–কর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনের সংসদ সদস্যকে বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষণার পর থেকেই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ বিশ্বাসের স্ত্রী বেগম আশানুর বিশ্বাসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এই আসন থেকে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল লতিফ বিশ্বাস নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে তাঁর পরিবর্তে আবদুল মজিদ মণ্ডল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবদুল মজিদ মণ্ডলের ছেলে আবদুল মোমিন মণ্ডল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন।

আমরা দলের কোন্দল মেটানোর জন্য কাজ করছি। আশা করছি, বেলকুচির বিষয়টি অচিরেই বসে ঠিক করা সম্ভব হবে।
কে এম হোসেন আলী, সভাপতি, সিরাজগঞ্জ,আ.লীগ

আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের কয়েকজন নেতা–কর্মী বলেন, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর থেকেই আবদুল লতিফ বিশ্বাস ও আবদুল মোমিন মণ্ডলের পরিবারের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ শুরু হয়েছে। সেই বিরোধের কারণেই তাঁদের পক্ষের নেতা–কর্মীরা পৃথকভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন। 

গত ১১ ফেব্রুয়ারি বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলীয় শান্তি সমাবেশ হয়। সমাবেশে বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মোমিন ও তাঁর অনুসারীরা অংশ নেননি । তবে সেই সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশানুর বিশ্বাসের অনুসারীরা অংশ নেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ডিএসএ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বেলকুচি সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় সংসদ সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোমিন ও তাঁর অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন। এ কারণে সেই সভায়  সাধারণ সম্পাদক ও তাঁর অনুসারীরা অংশ নেন।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজশাহীর জনসভায় তাঁরা পৃথকভাবে তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে যোগ দেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, মোহাম্মদ আলী বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য আবদুল মোমিনের অসহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগ মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। কমিটি গঠনসহ নানা ক্ষেত্রে দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কোনো প্রকার কথা না বলে একক সিদ্ধান্তে দল চরম ক্ষতির মধ্যে আছে।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কে এম হোসেন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের যেকোনো সিদ্ধান্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সবাইকে নিয়ে নিতে হবে। আমরা এরই মধ্যে দলের কোন্দল মেটানোর জন্য কাজ করছি। আশা করছি, বেলকুচির বিষয়টি অচিরেই বসে ঠিক করা সম্ভব হবে।’

সম্প্রতি আবদুল মোমিনের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পক্ষের নেতা–কর্মীদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য তাঁর নিজ বলয় তৈরি করতে দলে জামায়াত, বিএনপির নেতা–কর্মীদের স্থান করে দিচ্ছেন। তাঁর একক সিদ্ধান্তে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন কমিটি গঠনের ফলে সভাপতি ও নেতা–কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতায় দল দুর্বল করে তুলেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে সমন্বয় না করে একক সিদ্ধান্তে কমিটি দিচ্ছেন তিনি। আর এসব বিষয়ে তাঁরা জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশা নূর বিশ্বাস বলেন, ‘বেলকুচি উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে ইতিমধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব বাধাবিপত্তির মধ্যে কমিটি গঠন করা হলেও সংসদ সদস্য এককভাবে তাঁর মনোনীত ইউনিয়নের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক একজনকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করছেন। এরই মধ্যে বেলকুচি সদর ইউনিয়নের সাধারণত সম্পাদক মির্জা মরিয়মকে বাদ দিয়ে সভাপতিকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেছেন তিনি। এ ছাড়া দৌলতপুর ও বড়ধুল একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন।’

বেলকুচি সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মির্জা মরিয়ম বলেন, ‘আমি সদর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক অথচ আমাকে বাদ দিয়ে আমার কমিটি পূর্ণাঙ্গ করে পরিচিতি সভা করেছেন সংসদ সদস্য। এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও জানেন না।’

ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে কথা বলার জন্য সংসদ সদস্য আবদুল মোমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে এসব বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সেলিম সরকার বলেন, ‘সংসদ সদস্য মহোদয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠক করে পাঁচটি ইউনিয়নের কমিটি অনুমোদন করেছেন। এখানে তাঁদের কোনো কথা থাকলে দলের ঊর্ধ্বতন নেতাদের বলতে পারেন। তবে সংসদ সদস্যর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য নয়।’