সংসার চালাতে ছেলেকে নিয়ে পিঠা-পিঁয়াজির দোকান মায়ের
ডিপ্লোমা প্রকৌশল পাস করা ছেলে অর্ণব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে যশোর শহরের একটি সড়কে পিঠা-পিঁয়াজির ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়েছেন হেলেনা পারভীন। তিনি নিজেও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। কোনো কাজই ছোট নয়—এমন চিন্তা থেকে সংসার চালানোর তাগিদে ভ্যানের ওপর অস্থায়ী দোকান বসিয়ে কাজটি শুরু করেন মা ও ছেলে।
শহরের মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন মনি (প্যারিস রোড নামেও পরিচিত) সড়কের জুডিশিয়াল আদালত ভবনের ফটকের সামনে এই দোকানের অবস্থান। সেখানে অন্তত ৫০টি ভ্রাম্যমাণ পিঠাপুলি ও ভাজাপোড়ার দোকান আছে। গত বুধবার রাতে সরেজমিনে দেখা যায়, কিন্তু মা-ছেলের দোকানটি তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এ ছাড়া এর খাবারের স্বাদে আছে ভিন্নতা। মশা-মাছির প্রবেশ ঠেকাতে ভ্যানটির ওপরের তিন পাশ জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আর পিঠা-পেঁয়াজি-বড়া-চপ ভাজতে ব্যবহৃত তেল ও অন্য মসলাও বেশ পরিচ্ছন্ন। এর পেছনে হেলেনার যুক্তি হলো, ‘ব্যবসায় লাভ দুই টাকা কম হোক। কিন্তু আমার খাবার খেয়ে কাস্টমারেরা যাতে খুশি থাকে।’
হেলেনা ও অর্ণবের দোকানটির আপাতত কোনো নাম নেই। বাড়ি থেকে সব সরঞ্জাম নিয়ে দুপুরের পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ দোকান চালান তাঁরা। সেখানে বানানো প্রতিটি পুলি পিঠার দাম ১০ টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি পেঁয়াজি, ডালবড়া, বেগুনি, আলুচপের দাম ৫ টাকা করে। দোকানটির চারপাশে দাঁড়িয়ে-বসে অনেক ক্রেতাকেই পিঠা-পেঁয়াজি-চপ খেতে দেখা যায়। তাঁদের ই একজন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহজাহান কবীর। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত মা-ছেলের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। দোকানটির প্রতিটি খাবারই সুস্বাদু। আর দামেও সস্তা। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, ভাজার তেল ও অন্য মসলাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যেটা নিশ্চিত করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’
শিক্ষিত মা-ছেলের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। দোকানটির প্রতিটি খাবারই সুস্বাদু। আর দামেও সস্তা। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, ভাজার তেল ও অন্য মসলাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যেটা নিশ্চিত করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।শাহজাহান কবীর, শিক্ষক, যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আবারও কথা হয় হেলেনার। তিনি জানান, যশোর শহরের পুরোনো কসবা কাজীপাড়া এলাকার একটি ভাড়াবাড়িতে দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। বড় ছেলে অর্ণব হোসেন ২০২১ সালে যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পাস করেন। আর ছোট ছেলে শাহরিয়ার অরিন যশোর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কম্পিউটার বিভাগে লেখাপড়া করছেন। গত বছরের নভেম্বরে স্বামী সাইদুল ইসলামকে হারিয়েছেন হেলেনা। সাইদুলের কিডনিজনিত সমস্যা থাকায় মাঝেমধ্যে ডায়ালাইসিস করাতে হতো। এ জন্য ছেলে অর্ণবকে যশোরের বাইরে কোথাও চাকরি করতে দিতে চাননি তাঁরা। চিকিৎসা আর দুই ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে কোনো সম্পদ করতে পারেননি।
অর্ণব জানান, তাঁদের গ্রামের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। যশোর সেনানিবাসে ইলেকট্রিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরির কারণে প্রায় ২৪ বছর আগে যশোরে চলে আসেন তাঁর বাবা।
এ ব্যবসার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে হেলেনা বলেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যুর দুই মাস আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে অর্ণবকে বললাম, “বাবা কিছু না করলে তো আর হয় না। চলো, আমরা ডাল, বড়া, ছোলা রান্না করে ফুটপাতে বিক্রি করি।” এরপরে আমরা ছোট একটা টেবিল নিয়ে শহরে চৌরাস্তা মোড়ে থানার সামনে বিক্রি শুরু করলাম। প্রথম দিনে ৮০০ টাকা বিক্রি করি। এতে ৪০০ টাকার মতো লাভ হয়। এরপর আমাদের ব্যবসার সরঞ্জাম কেনার জন্য এক ব্যক্তি আড়াই হাজার টাকা দেন। আরেক আত্মীয় দেন ১০ হাজার টাকা। সেই টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা দিয়ে ভ্যানগাড়িটি কিনে প্যারিস রোডে ব্যবসা শুরু করেছি। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা লাভ হলেই আমরা খুশি।’