মা-বাবার কবরের পাশে চিরঘুমে কবি মোহাম্মদ রফিক, স্বজন-সতীর্থদের স্মৃতিচারণা
এবার বৃষ্টি দেখতে বাগেরহাটে এসেছিলেন তিনি। প্রকৃতিও যেন সেই প্রত্যাশা পূরণেরই অপেক্ষায় ছিল। গত ৩১ জুলাই বিকেলে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট সদরের চিতলী-বৈটপুরে পৌঁছানোর পর থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। তবে কবির যে মন ভরছিল না। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনার আক্ষেপ ছিল। সেই আক্ষেপ নিয়েই চলে গেলেন কবি মোহাম্মদ রফিক।
আজ সোমবার বেলা ১১টায় বাগেরহাট শহরতলির চিতলী-বৈটপুর এলাকার উদ্দীপন বদর-সামছু বিদ্যানিকেতনে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মা–বাবার কবরের পাশে কবি মোহাম্মদ রফিককে সমাহিত করা হয়েছে। স্বজন-সতীর্থরা করছেন নানা স্মৃতিচারণা।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, এক সপ্তাহ আগে ছোট ছেলে শুদ্ধসত্ত্ব রফিককে নিয়ে বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে আসেন কবি মোহাম্মদ রফিক। গতকাল রোববার সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কবিকে প্রথমে বাগেরহাটে একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে বরিশালে চিকিৎসক ছোট বোন অধ্যাপক সেলিনা পারভীনের ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোববার রাতে ঢাকা নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি দুই ছেলে, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বৃষ্টির মধ্যেও গ্রামবাসী, কবির ছাত্র, অনুজ, রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা তাঁকে একনজর দেখার জন্য ভিড় করতে থাকেন। তাঁরা ফুল দিয়ে কবিকে শেষশ্রদ্ধা জানান। এর আগে রোববার রাত পৌনে একটায় কবির মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়।
কবির জানাজায় অংশ নেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ, কবির বোনের স্বামী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আমিনুল হক, কবির বোন গাইনিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সেলিনা পারভীন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সবিতা ইয়াসমিন, কবির ভাই প্রকৌশলী মো. শফিক, কবির ছোট ছেলে অধ্যাপক শুদ্ধসত্ত্ব রফিক, কবির বিভিন্ন স্বজন, লেখক ও অনুবাদক মোরশেদুর রহমান, সামছুদ্দিন–নাহার ট্রাস্টের প্রধান সমন্বয়ক সুব্রত কুমার মুখার্জীসহ স্থানীয় বিশিষ্টজন ও কবি পরিবারের গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উদ্দীপন বদর-সামছু বিদ্যানিকেতনসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
প্রিয় কবিকে হারিয়ে শোকাহত হয়ে পড়েন কবির শিক্ষার্থী, স্বজন, সতীর্থ ও স্থানীয় লোকজন। কবির ভাই মো. শফিক বলেন, ‘আমাদের আট ভাই-বোনের মধ্যে কবি মোহাম্মদ রফিক ছিলেন সবার বড়। তিনি শুধু আমাদের বড় ভাই ছিলেন না, তিনি আমাদের সবার অভিভাবক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা অভিভাবকশূন্য হলাম।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘স্যার, একজন ভালো ও নিরহংকার মানুষ ছিলেন। দেশের জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দেশের জন্য তাঁর কলম চলত সব সময়। স্যারের অবদান ভোলার নয়।’
জানাজা ও দাফন শেষে বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চান কবির ছোট ছেলে অধ্যাপক শুদ্ধসত্ত্ব রফিক। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একটা অন্য বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। দেশটা সুন্দর হলে বাবা শান্তি পাবেন।’
ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন কবি মোহাম্মদ রফিক। তিনি ১৯৪৩ সালের ২৩ অক্টোবর বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের চিতলী-বৈটপুরে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সামছুদ্দীন আহমদ এবং মা রেশাতুন নাহারের আট সন্তানের মধ্যে মোহাম্মদ রফিক ছিলেন সবার বড়। কবি রফিকের শৈশব কাটে বাগেরহাটে। ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকার নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু পরে ঢাকা কলেজে মানবিক বিভাগে চলে যান।
১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন মোহাম্মদ রফিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। তবে এমএ পরীক্ষার জন্য তিনি ছাড়া পান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন রফিক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৯ সালের ২৯ জুন তিনি অবসরে যান। অবসরের পর কবি মোহাম্মদ রফিক রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাড়িতে বসবাস করছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগসহ বিভিন্ন শরীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
কবি মোহাম্মদ রফিক ঢাকায় থাকলেও এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পৈতৃক ভিটায় গড়ে তোলেন সামছুদ্দীন–নাহার ট্রাস্ট নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। কবি মোহাম্মদ রফিক ছিলেন ওই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ট্রাস্টি।
১৯৭০ সালে কবি মোহাম্মদ রফিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধুলার সংসারে এই মাটি’। মোহাম্মদ রফিক একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার অর্জন করেছেন।
কবিকে খুব কাছ থেকে দেখা বৈটপুর গ্রামের তৈয়বুর রহমান বলেন, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও কোনো দিন ভাতা গ্রহণ করেননি। তাঁর মায়ের কবর গ্রামে। মায়ের কাছে থাকার জন্য তিনি প্রায়ই গ্রামে আসতেন। স্কুল, চিকিৎসালয়সহ নানা সমাজকর্মে সব সময় মনোনিবেশ করতেন। তিনি সংগ্রামী ছিলেন। জেল খেটেছেন, রাজটিকিট পেয়েছেন। আইয়ুব খান তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়ার পরও তিনি দমেননি। তিনি সৎ ও সাহসী ছিলেন, যা তাঁর দেখায় অতুলনীয়। তিনি সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরতেন।
বাগেরহাটে এলে কবি আড্ডা দিতেন ইংরেজি সাহিত্যের অনুবাদক, লেখক ও নাট্যসংগঠক মোর্শেদুর রহমান সাগরের সঙ্গে। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদ রফিক একজন বাঙালি ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন এই ভেবে যে আমরা আমাদের বাঙালিত্ব হারাচ্ছি। আমরা কেউ বাঙালি মুসলমান অথবা কেউ বাঙালি হিন্দু হতে চাচ্ছি। কিন্তু বাঙালির জায়গাটা শূন্য থেকে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, বাগেরহাটে আসার কদিন আগে থেকেই কবি ফোন করছিলেন। এবার তিনি বাগেরহাটে এসেছিলেন বৃষ্টি দেখবেন বলে। কিন্তু বৃষ্টি দেখে তাঁর মনঃপূত হচ্ছিল না। তিনি চাইছিলেন টিনের চালের ওপর বৃষ্টি পড়বে, তা শুনবেন। তাঁর শরীর আর সায় দিল না। শারীরিক অবস্থার কথা কবিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি রেগে গিয়ে বলতেন, “তুমি শরীরের কথা বলবা না। আমার মস্তিষ্ক সচল আছে কি না, সেটাই আসল। মস্তিষ্ক বেঁচে থাকলে মনে করবা আমি বেঁচে আছি।”
১৯৭০ সালে কবি মোহাম্মদ রফিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধুলার সংসারে এই মাটি’। মোহাম্মদ রফিক একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার অর্জন করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘কপিলা’, ‘খোলা কবিতা, ‘গাওদিয়া’, ‘মানব পদাবলী’, ‘আত্মরক্ষার প্রতিবেদন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।