ময়মনসিংহ নগরে বাড়িভাড়া, জমি বিক্রিতে ‘হানি ট্র্যাপ’

ময়মনসিংহ নগরে গত চার মাসে এমন চারটি ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা। পুলিশ একাধিক প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে।

প্রতারণাপ্রতীকী ছবি

কখনো বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে, কখনো জমি কেনার কথা বলে, কখনোবা মুঠোফোনে সম্পর্ক তৈরি করে পাতা হয় ‘ফাঁদ’। এরপর ডাকা হয় বাসায়। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাসায় গেলেই বাধে বিপত্তি। সেখানে জোর করে নারীদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে ‘ব্ল্যাকমেল’ করা হয়। একপর্যায়ে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি ময়মনসিংহ নগরে প্রায়ই এমন ধরনের অপরাধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের মুখে মুখে যা পরিচিতি পেয়েছে ‘হানি ট্র্যাপ’ নামে। এমন চারটি ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা। পুলিশ একাধিক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে।

ময়মনসিংহ মহানগর সুজনের সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, বর্তমান সময়ে শহরের একটি আলোচিত অপরাধের নাম হানি ট্র্যাপ। এই অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে তরুণীদের। শহরের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগে কাদের দেওয়া হচ্ছে, কারা আসছে, কারা যাচ্ছে তা দেখা হচ্ছে না। আবার প্রশাসনেরও তদারকি নেই। এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করার আগে প্রশাসন ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

যতভাবে পাতা হয় প্রতারণার ফাঁদ

ফেসবুকে ‘টু-লেট’ (বাড়িভাড়া) বিজ্ঞাপন দেখে ১১ সেপ্টেম্বর নগরের গুলকিবাড়ী এলাকার ফখরুজ্জামান টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় গিয়েছিলেন আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র নাজমুল হাসান। সেখানে যাওয়া মাত্রই চার তরুণী ও চার তরুণ তাঁকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেন। এরপর মারধর করে সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন নাজমুল হাসান। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে পুলিশ সাদিয়া জাহান ওরফে মেঘলা ও ফারিয়া আক্তার ওরফে পায়েল নামের দুই তরুণীকে গ্রেপ্তার করে।

শহরের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগে কাদের দেওয়া হচ্ছে, কারা আসছে, কারা যাচ্ছে তা দেখা হচ্ছে না। আবার প্রশাসনেরও তদারকি নেই। এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করার আগে প্রশাসন ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।
আলী ইউসুফ  সম্পাদক, সুজন, ময়মনসিংহ মহানগর

চক্রের নেতৃত্বে চিহ্নিত অপরাধীরা

গত ২ জুন নগরের মাসকান্দা এলাকা থেকে প্রাইভেট কারচালক স্বপন মিয়াকে চাকু ঠেকিয়ে তুলে নিয়ে যায় একটি দল। তাঁকে নগরের আকুয়া গরুখোঁয়াড় মোড়ের একটি ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। সেখানে একটি কক্ষে এক নারীর সঙ্গে তাঁর ছবি ও ভিডিও ধারণ করা হয়। এরপর সেগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। একপর্যায়ে স্বপন মিয়া স্ত্রীকে ফোন করে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে ৪০ হাজার টাকা এনে দেন। এরপর ছাড়া পান স্বপন। এ ঘটনায় ৪ জুন ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়। পুলিশ জানায়, সেই মামলার ৫ নম্বর আসামি ছিলেন মো. নূর উদ্দিন আকন্দ (৩৮)। তিনি আকুয়া এলাকায় নিজের সিন্ডিকেট গড়ে তুলে মাদক ব্যবসা, অপহরণ, হানি ট্র্যাপের ঘটনাগুলোর নেতৃত্বে দিতেন।

গত ৮ এপ্রিল ময়মনসিংহ শহরে এসে অপহরণের শিকার হন সিলেটের জকিগঞ্জের জাকির হোসেন। ৯ এপ্রিল থানায় মামলা হলে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ নূর উদ্দিন আকন্দকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রমাণ পায়। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর নূর উদ্দিনকে দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়।

ময়মনসিংহ ৩ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবুল হোসেন বলেন, নূর উদ্দিন আকন্দের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণসহ ১৭টি মামলা রয়েছে। মেয়েদের সঙ্গে ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করা, অপহরণ, পরিবার ও বিকাশের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হতো। এই চক্রের মূল হোতা ছিলেন নূর উদ্দিন।

পুলিশে দিতে হবে ভাড়াটেদের তথ্য

‘হানি ট্র্যাপের’ মাধ্যমে প্রতারণা আগে থেকেই ছিল বলে জানালেন ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে একজন নারীকে দিয়ে ফাঁদ পাতা হয়। বিজ্ঞাপন দেখে যাঁরা মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের ‘ভিকটিমাইজড’ করা হয়। তারপর ঘরে নিয়ে বিভিন্নভাবে ছবি তোলা হয়, মারধর করে তাঁদের ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করা হয়। বিভিন্ন ঘটনা যাচাই করে দেখা গেছে, প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের।

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্প্রতি কিছু ঘটনা সামনে আসায় শহরের বাসার মালিকদের বলা হয়েছে, নতুন কোনো ভাড়াটে উঠলে অবশ্যই পুলিশকে অবগত করতে। এর মাধ্যমে প্রতারক চক্রের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতারণার শিকার হয়ে মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশে কমানো যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।