ঝুঁকিতে বেড়িবাঁধ, আতঙ্ক

জেলায় মোট বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৮১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ রয়েছে ১৪ কিলোমিটার।

ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে উপকূলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চর মোন্তাজ ইউনিয়নের দক্ষিণ চর মোন্তাজ এলাকার বুড়াগৌড়াঙ্গ নদের পাড়েছবি: সংগৃহীত

আন্দারমানিক নদীপাড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের ঢালে ছোট ঝুপড়িতে বাস করছেন আবদুর রহিম (৬২)। পেশায় জেলে। বেড়িবাঁধ কিছু অংশ আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। এদিকে ঘূর্ণিঝড় আসছে—এ খবরে এখন আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর। কারণ, ঘূর্ণিঝড়ে নদীতে পানি বাড়লেই জলোচ্ছ্বাসে তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল বসতঘরটি আবার ভেসে যাবে।

আবদুর রহিম পটুয়াখালীর উপকূলীয় কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের গৈয়াতলা গ্রামের বাসিন্দা। আবদুর রহিম জানান, সিডরের সময় বেড়িবাঁধের সঙ্গে তাঁর বসতঘরও ভেসে গিয়েছিল। তখন স্ত্রী মিনারা বেগম শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে গাছ ধরে বেঁচেছিলেন। পরে নতুন করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। নতুন বাঁধের ভেতরে আবার বসতি গড়েছেন তাঁরা। কিন্তু সেই বাঁধ এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে। এতে আবার নতুন করে তাঁদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

গতকাল শনিবার সকালে গৈয়াতলা এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, নদীর পাড়ের বাঁধটির অনেক স্থান ভেঙে রয়েছে। আবার অনেক স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। জোয়ারের প্লাবনে যেকোনো সময়ে সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে বাঁধটি। এদিকে গৈয়াতলা এলাকায় বাঁধ রক্ষায় ভাঙন পয়েন্টে  জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

পাউবো পটুয়াখালী ও কলাপাড়া কার্যালয় জানায়, জেলায় মোট বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৮১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ রয়েছে ১৪ কিলোমিটার। পাউবোর কলাপাড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, কলাপাড়ার নীলগঞ্জের গৈয়াতলা এলাকায় ৭০০ মিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ধুলাশ্বর এলাকায় ৬০ মিটার, রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজে ১২০ মিটারসহ দুই উপজেলায় মোট ৬ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাঁধের ঢালে বসতি গড়েছেন মো. হানিফ হাওলাদার (৪৫) নামের অপর এক জেলে। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস হলেই পানির চাপে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনকি বাঁধ ভেঙে ভেসে যেতেও পারে। ঝড়ের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ছে।

হানিফের স্ত্রী কুলসুম বেগম (৩৫) জানান, ‘ঝড় বইন্যার খবর আইলেই চার সন্তান লইয়া ভয়ে থাকতে হয়। বাঁধ ভাঙলেই তাগো ঝুপড়ি ঘরডাও পানিতে ভাসাইয়া লইয়া যাইবে। মজবুদ বাঁধ থাকলে ভয় থাকত না।’

নীলগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যান মো. বাবুল মিয়া বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে যদি তিন থেকে পাঁচ ফুট পানি বাড়ে, তাহলে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে পানি ভেতরে প্রবেশ করবে। লোনাপানিতে প্লাবিত হবে গৈয়াতলা, সোনাতলা ও মোস্তফাপুর—এই তিন গ্রামের বাড়িঘরসহ অন্তত ২০ হাজার একর ফসলি জমি।

বাবুল মিয়া আরও জানান, বন্যার পূর্বাভাস শুনে বাঁধসংলগ্ন সবাইকে নিরাপদে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইউপি সদস্যদের এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবকেরা ইতিমধ্যে প্রস্তুতি হিসেবে এলাকায় এসে নদীর পাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের আতঙ্কিত না হয়ে নিরাপদ আশ্রয় যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ ইউনিয়নের বুড়াগৌরাঙ্গ নদের পাড়ে বেড়িবাঁধসংলগ্ন আবাসনের রমেশ মণ্ডল (৫০) ও মালতী রানী (৪৫) বাস করেন। রমেশ জানান, বাসার সামনেই বুড়াগৌড়াঙ্গ নদের ঘূর্ণিস্রোত এসে পড়ছে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের মাটি বড় বড় এলাকা নিয়ে ধসে পড়ছে। এখন বন্যা এলে ভাঙনের তীব্রতা বাড়বে। নদের ভাঙনে বাড়িঘর সব হারিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি আবাসনে। এবার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গেলে আবাসনের আশ্রয়টুকুও তাঁদের হারাতে হবে।

পাউবোর পটুয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, তাঁদের আওতায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে মির্জাগঞ্জের পিঁপড়াখালীতে পায়রা নদীর পাড়ে ২ কিলোমিটার, কাঁকড়াবুনিয়া এলাকায় প্রায় দেড় কিলোমিটারসহ বিভিন্ন অংশে মোট ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দুর্যোগের সময় কোথাও ভাঙন দেখা দিলে ভাঙন মোকাবিলায় ১৬ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।