লোনা জমিতে সাফল্য
বিনা চাষে গম উৎপাদন
উপজেলার পূর্ব দৌলতপুর গ্রামের ১৭ জন কৃষক ১৭ বিঘা জমিতে লবণসহিষ্ণু গমের বীজ বপন করেছেন। তাঁরা খেতে কোনো চাষ দেননি।
প্রান্তিক কৃষক সরোয়ার হোসেন। লবণাক্ততার কারণে নিজের আট বিঘা জমিই রবি মৌসুমে পতিত থাকে। গত মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে এক বিঘা জমিতে গমের আবাদ করেন তিনি। বিনা চাষে আমনখেতে বীজ ছিটিয়ে দিয়েছেন। আমন ফসল ঘরে তুলেছেন। এখন খেতে গমের গাছ বেড়ে উঠছে। ইতিমধ্যে গাছে গাছে গমের ছড়া এসেছে। গমের ফলন দেখে খুব খুশি কৃষক সরোয়ার।
কৃষক সরোয়ার পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা। সরোয়ারেরই মতো ওই গ্রামের ১১ কৃষক গত বছর ১১ বিঘা লবণাক্ত অনাবাদি জমিতে বিনা চাষে গমের আবাদ করেছেন।
আগামী বছরের মধ্যেই এই প্রকল্প আরও অধিক কার্যকর লবণসহিষ্ণু গমের জাত বের করতে পারবে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে আমন ধান কাটার পর বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে চাষাবাদ করে শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা একটি অতিরিক্ত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের গ্রাম পূর্ব দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আন্দারমানিক নদ। সাগর উপকূলীয় এলাকায় বয়ে যাওয়া আন্দারমানিক নদের পানি শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত হয়ে যায়। এর ফলে দৌলতপুরসহ ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রামের ফসলি জমিতে লবণাক্ততার সৃষ্টি হয়। এলাকায় মিঠাপানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা তেমন নেই। এ কারণে ওই গ্রামের কৃষক শুধু আমন ফসলের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবছর রবি মৌসুমে কয়েক হাজার হেক্টর আবাদি জমি পতিত পড়ে থাকে।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে পতিত পড়ে থাকা জমি আবাদের আওতায় আনতে পাঁচ বছর ধরে লবণসহিষ্ণু গমের জাত উদ্ভাবনের কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা। তাঁরা যৌথভাবে গবেষণা করে আসছেন। তাঁদের গবেষণায় উৎপাদিত লবণসহিষ্ণু গমবীজ দিয়ে বিনা চাষেই গম উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
পূর্ব দৌলতপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষক বলেন, গত বছর রবি মৌসুমে ১১ জন কৃষক ১১ বিঘা পতিত জমিতে প্রথমবারের মতো লবণসহিষ্ণু গমের আবাদ করে সাফল্য পান। এবারও তাঁরা বিনা চাষে গমের আবাদ করেছেন। গমের ফলন ভালো দেখে আরও ১৭ জন কৃষক ১৭ বিঘা জমিতে লবণসহিষ্ণু গমবীজ বপন করেছেন।
কৃষক সরোয়ার জানান, প্রথম বছর এক বিঘা জমিতে গমের আবাদ করে তিনি সাত মণ গম পেয়েছিলেন। বিক্রি করেছিলেন প্রতি মণ ১ হাজার ৬০০ টাকা করে। কিন্তু এ বছর দাম বেড়ে প্রতি মণ হয়েছে তিন হাজার টাকা, যা ধানের দামের দ্বিগুণের বেশি। এ কারণে এলাকার কৃষকেরা গম আবাদের দিকে ঝুঁকছেন।
সরেজমিন ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খেতের আমন ফসল আগেই কেটে ঘরে তুলেছেন কৃষকেরা। এলাকার শত শত হেক্টর আবাদি জমি পতিত পড়ে রয়েছে। তবে পূর্ব দৌলতপুর গ্রামের ভেতরে গেলে চোখে পড়বে বিশাল এলাকা নিয়ে গমের খেত এবং শুধু সবুজ আর সবুজ।
খালেক ফারুকী নামের গ্রামের এক কৃষক তাঁর খেতে বসে গম দেখছেন। তিনি বলেন, এই এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে গ্রামের ১১ জন কৃষক ১১ বিঘা জমিতে গমের আবাদ করেছেন। তাঁরা খেতে কোনো চাষ দেননি। আমন আবাদের পর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খেতে গমের বীজ ছিটিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ওই সময়ে খেতের মাটি নরম ও ভেজা থাকে। ইতিমধ্যে তাঁরা আমন ফসল ঘরে তুলেছেন। এখন গম উঠবে। এ মাসের মধ্যে গম কেটে ঘরে তুলতে পারবেন তাঁরা। অনেক কৃষক এখন তাঁদের গমখেত দেখতে আসেন।
এ দিকে গম আবাদে সফলতা দেখে এ বছর ওই এলাকায় আরও ১৭ জন কৃষক নিজেদের উদ্যোগে ২২ বিঘা জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের গমের আবাদ করেছেন। নীলগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান মো. বাবুল মিয়া জানান, ইউনিয়নের আন্দারমানিক নদতীরের পূর্ব দৌলতপুর, উত্তর দৌলতপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর, আমিরাবাদ, রোসনাবাদ, মকিমপুরসহ অন্তত ১০টি গ্রামের ফসলি জমি লবণাক্ততার কারণে রবি মৌসুমে পতিত থাকে। গম আবাদে সফলতায় লাভবান হবেন কৃষক।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পটুয়াখালী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ জেলায় মাঝারি থেকে অত্যাধিক লবণাক্ত জমির পরিমাণ ৫৮ হাজার ৭৫০ হেক্টর। রবি মৌসুমে এই জমি পতিত থাকে।
শুষ্ক মৌসুমে এই অনাবাদি জমিকে আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়ার সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগরিকালচার রিচার্স (এসিআইএআর) এবং বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়ের্স্টান অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সাল থেকে গবেষণা করে আসছে।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার এম জি নিয়োগী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের উদ্ভাবিত দুই জাতের লবণসহিষ্ণু গমের বীজের পাশাপাশি বারি গম ২৫ এবং ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ও জিংকসমৃদ্ধ জাত বারি গম ৩৩ বীজ দিয়ে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় প্রদর্শনী খেত করা হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যেই এই প্রকল্প আরও অধিক কার্যকর লবণসহিষ্ণু গমের জাত বের করতে পারবে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে আমন ধান কাটার পর বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে চাষাবাদ করে শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা একটি অতিরিক্ত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।
লবণসহিষ্ণু জমিতে বিনা চাষে গমের আবাদ দেখতে গত সোমবার অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিনিধিদল পটুয়াখালীর কলাপাড়ার দৌলতপুর গ্রামে এসেছিল। ১৬ সদস্যের এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন ফিওনা সিমসন। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তিতে কোনো প্রকার চাষ ছাড়াই অত্যন্ত কম খরচে মানসম্পন্ন গম উৎপাদন করা যায়। কৃষকেরা গম আবাদের দিকে ঝুঁকবেন। আবাদযোগ্য পতিত পড়ে থাকা জমি গম আবাদের আওতায় আসবে।