নষ্ট হচ্ছে কৃষি আবহাওয়ার যন্ত্রপাতি 

১৫টি ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে কৃষি তথ্য বোর্ডে হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি, যন্ত্রপাতি অকেজো পড়ে আছে। জেলার বেশির ভাগ ইউপির চিত্র প্রায় একই।

পাখি বাসা বেঁধেছে কৃষি আবহাওয়ার তথ্য বোর্ডে। সম্প্রতি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজহাট ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

কৃষকদের কৃষি আবহাওয়াবিষয়ক নির্ভরযোগ্য তথ্য ও পূর্বাভাস জানাতে যশোরের ৭৭টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) কার্যালয়ে স্থাপন করা তথ্য বোর্ড, স্বয়ংক্রিয় বৃষ্টি পরিমাপক যন্ত্র বা রেইন গজ মিটার ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল কাজে আসছে না।

দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে এসব যন্ত্রপাতি। শুধু তা-ই নয়, কৃষি আবহাওয়ার তথ্য জানাতে যাঁদের জন্য এত আয়োজন, সেই কৃষকই তথ্য বোর্ডের ব্যাপারে কিছু জানেন না। 

যশোরের ১৫টি ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে কৃষি তথ্য বোর্ডে হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলার অন্যান্য ইউনিয়নেও খোঁজ নিয়ে বেশির ভাগের একই চিত্র পাওয়া গেছে। 

বাঘারপাড়া উপজেলার ধুপখালী গ্রামের ‍কৃষক গোলাম খায়বার মোল্যা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফসলের জন্য আবহাওয়ার নির্ভরযোগ্য তথ্য ও পূর্বাভাস জানা জরুরি। অনেক সময় কোনো পূর্বাভাস না পাওয়ায় ঝড়বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হয়। ইউনিয়ন পরিষদে আবহাওয়ার নির্ভরযোগ্য হালনাগাদ তথ্য ও পূর্বাভাস জানানোর ব্যবস্থা আছে, আগে কখনো শুনিনি।’

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পদ্ধতিটি অ্যানালগভিত্তিক। জেলার কৃষি আবহাওয়া তথ্য বোর্ডগুলো কার্যকর আছে। আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিন এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বোর্ডে দেওয়া হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয় সূত্র জানায়, কৃষি আবহাওয়ার তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের আওতায় যশোরের আটটি উপজেলায় ৯৩টি ইউনিয়নের ৭৭টিতে ইউপি কার্যালয়ের ছাদে স্থাপন করা হয়েছে স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। ইউপি ভবনের দর্শনীয় স্থানে স্থাপন করা হয়েছে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার তথ্য বোর্ড। এই বোর্ডের মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়ের পূর্বাভাস, আলোক ঘণ্টাসহ ১০টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও তা প্রকাশের ব্যবস্থা রয়েছে। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, আগে ও পরের তিন দিনের কৃষিভিত্তিক আবহাওয়ার নানা তথ্য এই বোর্ডে হালনাগাদ থাকার কথা। তবে ২০১৭ সালে প্রতিটি তথ্য বোর্ড, স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, তার কোনো তথ্য দিতে পারেনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়।

গত ২ থেকে ৬ মার্চ বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজহাট ইউপি, দোহাকুলা, ধলগ্রাম, রায়পুর, নারিকেলবাড়িয়া ও বন্দবিলা; অভয়নগরের প্রেমবাগ ইউপি, শ্রীধরপুর, চলিশিয়া, সুন্দলী ও সিদ্দিপাশা; মনিরামপুরের মনোহরপুর ইউপি ও হরিদাসকাটি; যশোর সদরের নওয়াপাড়া ইউপি এবং ঝিকরগাছা সদর ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, তথ্য বোর্ড রয়েছে ভবনের নিচতলায়। তবে মনিরামপুর উপজেলার হরিদাসকাটি ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য বোর্ড খুলে পরিষদের স্টোররুমে রাখা হয়েছে। চারটি ইউপির তথ্য বোর্ডের ‘আগামী তিন দিনের আবহাওয়াভিত্তিক কৃষি বার্তা’র জায়গায় হাতে লেখা তথ্য আগের এবং অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা। দুটি ইউনিয়নের বোর্ডে বিপৎসংকেতের জায়গায় লেখা, তেমন কোনো বিপৎসংকেত নেই। সব ইউপির তথ্য বোর্ডে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়ের পূর্বাভাস, আলোক ঘণ্টার ১০টি তথ্যের নিচে সংখ্যার চাকাগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। 

বাঘারপাড়ার দরাজহাট ইউপির তথ্য বোর্ডে পাখি বাসা বেঁধেছে। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের ছাদে গিয়ে দেখা গেছে, ছাদে লোহার নাট-বল্টু দিয়ে আটকানো রয়েছে ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৮ ইঞ্চি ব্যাসের একটি প্লাস্টিকের স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার এবং ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ১০ ইঞ্চি প্রস্থের সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। সব স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। তবে মনিরামপুরের হরিদাসকাটি ইউপির ছাদে স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল পাওয়া যায়নি।

দরাজহাট ইউপির চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘কৃষি বিভাগের কর্মচারীদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা প্রতিদিনই আসেন। তাঁদের তথ্য বোর্ড হালনাগাদ করার কথা। কিন্তু তাঁরা ঠিকমতো হালনাগাদ করেন না। এখন থেকে তাঁদের তথ্য হালনাগাদ করতে বলব।’

কৃষি বিভাগের কর্মচারীদের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সেটি বন্ধ রয়েছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মচারী বলেন, ‘ভবনের ছাদে স্থাপন করা স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটারটি নষ্ট হয়ে গেছে। সৌরবিদ্যুতের প্যানেল থেকে তথ্য বোর্ডে সংযোগ আসছে না। তবে আমরা ঠিকমতো তথ্য লিখে থাকি।’

জানতে চাইলে কৃষি আবহাওয়ার তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শাহ কামাল খান প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। আগামী জুনে প্রকল্প শেষ হবে। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর ২০১৭ সালে এর কার্যক্রম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষি আবহাওয়া তথ্য বোর্ডে তথ্য হালনাগাদ করবেন। এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প’ নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ৪ হাজার ৫১টি ইউপিতে স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ ও কৃষি আবহাওয়া তথ্য বোর্ড, ৪৮৭টি উপজেলায় কিয়স্ক (একটি ছোট, অস্থায়ী, একক বুথ, যার মধ্যে একটি টাচ স্ক্রিন আছে) স্থাপন ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের আবহাওয়াবিষয়ক তথ্য পাঠানোর জন্য ইন্টারনেট সংযোগসহ ৬ হাজার ৬৬৪টি ট্যাব সরবরাহ করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১৯ কোটি টাকা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে টাকার পরিমাণ বেড়ে হয় ২১২ কোটি ৩৭ লাখ।