মেহেরপুরে বাণিজ্য মেলায় প্রবেশ টিকিটের নামে চলছে লটারি, বন্ধের দাবি বাসিন্দাদের
লটারিতে একটি মোটরসাইকেল জেতার আশায় ৮০ টাকায় চারটি টিকিট কিনেছিলেন ভ্যানচালক সজীব মিয়া। এতে তাঁর ভাগ্য না ফিরলেও দমে যাননি। গতকাল সোমবার দুপুরে আরও চারটি টিকিট কেনেন তিনি। মেহেরপুর সদরে র্যাফল ড্রর নামে মোটরসাইকেল বা অন্য উপহার জিততে এভাবে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, মেহেরপুর শহরের নতুন বাস টার্মিনাল এলাকায় স্বপ্নচূড়া সংগঠনের উদ্যোগে ৫ জুন থেকে চলছে মাসব্যাপী ‘দেশীয় শিল্প বাণিজ্য মেলা’। মেলায় প্রবেশ টিকিটের ওপর র্যাফল ড্রর নামে চলছে অবৈধ জুয়ার উৎসব। জেলা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আহসান হাবীব, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক তামিম হোসেন ও জেলার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য ইমতিয়াজ আহমেদসহ কয়েকজনের প্রত্যক্ষ মদদে এই লটারি চলছে। তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন।
সজীব মিয়া জানান, লটারিতে প্রতিদিন একটি করে নতুন মোটরসাইকেল উপহার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল পাওয়ার আশায় দৈনিক ৮০ টাকা দিয়ে চারটি করে টিকিট কিনেছেন। এর আগেও পাঁচ হাজার টাকার টিকিট কিনেছিলেন। তবে কিছুই পাননি। এবার আশা করছেন, হয়তো কিছু পাবেন।
গতকাল সোমবার দেখা গেছে, পৌর বাস টার্মিনাল এলাকায় শিল্প ও পণ্য বাণিজ্য মেলায় নানা পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা। মেলার প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে প্রবেশ টিকিট বিক্রি করছেন দুই ব্যক্তি। দর্শনার্থীদের বেশি ভিড় সেখানেই। সন্ধ্যা সাতটা থেকে সারা রাত চলে এই উন্মাদনা। প্যান্ডেলের সামনে লাকি কুপনের মঞ্চ। রাত ১১টায় শুরু হয় কুপনের ড্র। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ টিকিট বিক্রি না হলে আরও দেরিতে শুরু হয় এই লটারি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, র্যাফল ড্রর নামে একেবারে উন্মুক্তভাবে জুয়া চলছে মেহেরপুরে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ এসব অবৈধ জুয়া বন্ধ করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ১০২টি ইজিবাইকে মাইক লাগিয়ে জেলার অধিকাংশ এলাকায় দিনরাত চলেছে এসব টিকিট বিক্রি। মাত্র ২০ টাকা খরচ হবে ভেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই ভাগ্য পরীক্ষায় শামিল হচ্ছেন। প্রতিটি ইজিবাইকে এক হাজার করে লটারির টিকিট বিক্রির টার্গেট দেওয়া হয়। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা তুলে নিচ্ছে চক্রটি। অথচ পুরস্কার পাচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকজন। এসব পুরস্কারের মূল্য টিকিট বিক্রির করে অর্জিত অর্থের তুলনায় অনেক কম।
সমাজকর্মী রফিকুল ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা মিলে মেহেরপুরে জুয়ার আয়োজন করেছে। জনগণের টাকা লুটে নেওয়ার জন্য আয়োজন করা হয়েছে এই লটারি।
তবে এটিকে জুয়া মানতে নারাজ স্বপ্নচূড়া ফাউন্ডেশনের সভাপতি আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক শর্ত জুড়ে দিয়ে শিল্প ও বাণিজ্য মেলার অনুমতি দিয়েছে। র্যাফল ড্র তো জুয়ার মধ্যে পড়ে না। শর্ত মেনেই চলছে এটি।
মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল আমিন বলেন, জুয়া মানেই অবৈধ, সেটি যেভাবেই হোক না কেন। জেলা প্রশাসন এভাবে জুয়া খেলার অনুমোদন দিতে পারে না। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাণিজ্য মেলার নামে লটারির জুয়ার ড্র চলছে। জেলার সব অঞ্চলে ইজিবাইকের মাইকিং করে লোভনীয় পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে টিকিট দেওয়া হচ্ছে।
লটারিকে কেন্দ্র করে সামাজিক উৎপাত বেড়েছে বলে দাবি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ী মিনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, মেলায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, ছিনতাই, চুরি ও ইভ টিজিংয়ের ঘটনা বেড়েছে। লটারির নেশায় বুঁদ হয়েছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। পুরস্কারের লোভে বেশি টিকিট কিনে ইতিমধ্যেই মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়েছেন অনেকেই।
জেলা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় বড় পরিসরে বাণিজ্য মেলা করতে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন। তা ছাড়া র্যাফল ড্র বা লটারি তো অবৈধ নয়। জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই এসব হচ্ছে। অন্যদিকে জেলা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা আহসান হাবীব বলেন, প্রবেশে টিকিটের ওপর র্যাফল ড্র না থাকলে বাণিজ্য মেলা পরিচালনা সম্ভব নয়।
তবে এ বিষয়ে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সমন্বয়ক ও মেহেরপুর জেলার সংগঠক শাকিল আহমেদ। তিনি জানান, মেলার নামে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে এনসিপির কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ বলেন, শর্ত সাপেক্ষে মেহেরপুরের শিল্প বাণিজ্য মেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শর্ত লঙ্ঘন করে লটারিসহ অবৈধ কোনো কিছু হলে মেলার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে।