অপার সম্ভাবনা থাকলেও ময়মনসিংহে এগোচ্ছে না পর্যটনশিল্প

মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। সম্প্রতি ময়মনসিংহ নগরেছবি: প্রথম আলো

শিল্প-সংস্কৃতির নগর হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ। ২৩৮ বছরের প্রাচীন এই জেলায় আছে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা, কিন্তু পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য, স্থানীয় ও প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পর্যটনশিল্পের প্রসার থেমে গেছে।

ময়মনসিংহ জেলা শহর ছাড়াও আশপাশের উপজেলাগুলোতে দর্শনীয় স্থান থাকলেও পর্যটকের অভাব। ভ্রমণপিপাসুরা জানেন না পর্যটনসমৃদ্ধ এসব স্থানের খবর। জেলায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত ঘোষিত পুরাকীর্তি আছে ১১টি। এগুলোর ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম কিছুই জানে না বলে জানান পুরাকীর্তি সুরক্ষা কমিটি ময়মনসিংহ অঞ্চলের সদস্যসচিব ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, পর্যটনের সম্ভাবনাময় পুরাকীর্তিগুলোকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে মানুষকে আগ্রহী করলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় বাড়ত।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ময়মনসিংহ জেলা শাখার সম্পাদক ইয়াজদানী কোরাইশী বলেন, ‘আমাদের যা যা ঐতিহ্য আছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ আছে। কিন্তু মানুষ এখানে এসে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পান না। সুপরিসর রাস্তা নেই, পরিচ্ছন্নতার অভাব, সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পটগুলোর যত্ন নেই। এ ছাড়া পর্যটনের অন্যান্য সম্পদ যেমন খাদ্য ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর উপস্থাপন নেই। সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর উপস্থাপন থাকলে এখানে লোকজন আসতেন। নিয়মিত যদি মহুয়া পালা চলত, তা দেখতেই লোকজন আসতেন। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবের কারণে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা থমকে আছে। স্থানীয় নেতৃত্ব এগিয়ে এলে এবং রাষ্ট্র সহযোগিতা করলে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে।’

সরকারি তথ্য বাতায়ন ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র শশী লজ প্রাসাদ ও জাদুঘর; গৌরীপুর লজ; আলেকজান্ডার ক্যাসেল; শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা; স্বাধীনতার স্তম্ভ; ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী জয়নুল আবেদিন উদ্যান; মদন বাবুর বাড়ি; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন; ত্রিশালের নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র; নজরুল স্মৃতিবিজড়িত দারোগা বাড়ি; মুক্তাগাছা আটআনী জমিদারবাড়ি; মহারাজ সূর্যকান্তের বাড়ি; পাথরের শিবমন্দির; তিন শিবমন্দির; জোড়া মন্দির; হররামেশ্বর মন্দির; ভূঁইয়াবাড়ি জামে মসজিদ; গৌরীপুর রাজবাড়ি; বীরাঙ্গনা সখিনার মাজার; রামগোপাল জমিদারবাড়ি; ফুলবাড়িয়া অর্কিড বাগান; আনারস বাগান; রাবার বাগান; আবদ্ধ বিল বড়বিলা; ভালুকার কাদিগড় জাতীয় উদ্যান; কুমিরের খামার; তেপান্তর ফিল্ম সিটি; হালুয়াঘাটের গাবরাখালী পার্ক; ধোবাউড়ার চীনা মাটির টিলা; গফরগাঁওয়ে আবদুল জব্বার স্মৃতি জাদুঘর এবং ঈশ্বরগঞ্জে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত আঠারবাড়ি জমিদারবাড়ি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে। এ জন্য সঠিক পরিকল্পনা, সংস্কার ও প্রচার প্রয়োজন।

উদ্যোক্তাদের অভাবে ভালো মানের বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে না। যে স্পটগুলো আছে, সেগুলোর প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে না
নাইমুল হক, পুলিশ সুপার, ট্যুরিস্ট পুলিশ

ময়মনসিংহের সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, হালুয়াঘাটের গাবরাখালীতে পর্যটনের বিকাশের জন্য তাঁরা কাজ করছেন। পাশাপাশি এই জেলায় যেসব ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসসমৃদ্ধ স্থাপনা আছে, এগুলোকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতায় উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফুলপুর উপজেলায় পার্ক স্থাপন এবং গফরগাঁও উপজেলায় ইকো পার্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা চলছে।

ময়মনসিংহ শহরে এখন প্রায় ২০টির বেশি ট্যুরিজম গ্রুপ আছে, যারা নিয়মিত দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্যুরিস্টদের নিয়ে ভ্রমণে যায় বলে জানান ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব ময়মনসিংহের সদস্যসচিব এইচ এম মমিনুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে এ জেলা হবে দেশের অন্যতম পর্যটন জেলা। যার উদ্যোগ প্রশাসনকেই নিতে হবে আর এর বাস্তবায়ন করবে ট্যুরিজম গ্রুপ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ট্যুরিস্ট পুলিশ ময়মনসিংহ অঞ্চলের পুলিশ সুপার নাইমুল হক বলেন, উদ্যোক্তাদের অভাবে ভালো মানের বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে না। যে স্পটগুলো আছে, সেগুলোর প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে না। ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পট করে তোলা সম্ভব, কিন্তু নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে তা হচ্ছে না। দক্ষ পর্যটনকর্মীর অভাবও আছে। এ জেলা সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। কালচারাল ট্যুরিজম গড়ে ওঠা সম্ভব, কিন্তু উদ্যোগ নেই।