৬০ বছর ধরে যাত্রী পারাপার করা ‘সাধু মাঝির’ জীবনে সচ্ছলতা এল না
সব সময় পরনে থাকে সাদা লুঙ্গি। নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। বেশভূষা আর স্বভাবের কারণে সবার কাছে তিনি ‘সাধু মাঝি’ নামে পরিচিত। পিরোজপুর শহরের বলেশ্বর খেয়াঘাটে প্রায় ৬ দশক ধরে খেয়া পারাপার করেন ৭২ বছর বয়সী সাধু মাঝি। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে মাঝিদের দৈনিক আয় সামান্য। তবে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে রেখেছেন তিনি।
সাধু মাঝির প্রকৃত নাম দেবেন সিকদার। তবে এই নামে অনেকেই তাঁকে চেনেন না। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার মহিষপুরা গ্রামে সাধু মাঝির বাড়ি। প্রতিদিন ভোরে বলেশ্বর নদের পশ্চিম পাড়ের মহিষপুরা খেয়াঘাট থেকে পিরোজপুর শহরগামী কর্মজীবী মানুষ, ব্যবসায়ী আর শিক্ষার্থীরা খেয়ানৌকায় পার হন।
সম্প্রতি বলেশ্বর নদের খেয়া ঘাটে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় ৫০টি খেয়ানৌকা দাঁড়িয়ে আছে। এর বিপরীতে মাঝি আছেন ১৬ থেকে ১৭ জন। তাঁরা ভাগাভাগি করে খেয়া পারাপার করেন। খেয়া পার হয়ে বলেশ্বর নদের পশ্চিম পাড়ের মোরেলগঞ্জের কয়েকটি গ্রামের মানুষ ও শিক্ষার্থীরা পিরোজপুর শহরে যান। আবার বিদ্যালয় ছুটির পর এবং কাজ শেষে কর্মজীবী মানুষেরা বাড়ি ফেরেন।
খেয়ানৌকার মাঝিদের বেশির ভাগ বংশপরম্পরায় নৌকা চালানোকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
ঘাটের সবচেয়ে পুরোনো মাঝিদের মধ্যে একজন দেবেন সিকদার ওরফে সাধু মাঝি। দাদা চন্দ্রকান্ত সিকদার ব্রিটিশ আমলে বলেশ্বর নদে খেয়ানৌকায় যাত্রী পারাপার করতেন। এরপর চন্দ্রকান্ত সিকদারের ছেলে কার্তিক সিকদার বাবার পেশা বেছে নেন। বাবার পথ অনুসরণ করে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে হাতে বইঠা তুলে নেন দেবেন সিকদার। তবে তাঁর দুই ছেলে আর এই পেশায় যুক্ত হননি। বড় ছেলে দশরথ সিকদার একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারীর কাজ করেন। আর ছোট ছেলে হরিদাস সিকদার ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান।
দেবেন সিকদার বলেন, ‘বাপ-দাদার পেশা আমি ছাড়তে পারিনি। পাকিস্তান আমলে বাবার সঙ্গে নৌকা চালানো শুরু করি। তখন দুই পয়সায় খেয়ানৌকায় মানুষ পারাপার করতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাঁচ পয়সায় খেয়া পার করেছি। নব্বইয়ের দশকে এক টাকা, ২০১০ সাল থেকে দুই টাকায় খেয়া পার করতাম। ২০১৭ সালে এসে পাঁচ টাকায় এবং ২০২০ সাল থেকে সাত টাকা করে যাত্রী পার করছি।’
সারা দিন খেয়া পারাপার করে দেবেন সিকদার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। দেবেন সিকদার বলেন, যাত্রীর তুলনায় এখন ঘাটে খেয়ানৌকার সংখ্যা বেশি। খেয়া ঘাটের নিবন্ধিত ৫৩ জন মাঝির বেশির ভাগ এখন আর নৌকা চালান না। তবে ঘাটে যাঁরা নিয়মিত নৌকা চালান, তাঁদের আয়ের একটি অংশ ওই মাঝিদেরও দিতে হয়।
আক্ষেপের সুরে দেবেন সিকদার বলেন, ‘এখন সব জিনিসের দাম বাড়ছে। এই টাকা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ছেলেরা যা আয় করে তা দিয়ে ওদের চলতে কষ্ট হয়। ৭২ বছর বয়সে এখন আর কী কাজ করব! সংসার চালাতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এই পেশায় আছি। যা পাই তা দিয়ে কোনোরকমে চলছি। সারা জীবনই তো অভাব ছিল। তবে বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি। তাই সংসার চালাতে আগের চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে।’
দেবেন সিকদারের দাবি, বলেশ্বর নদে সেতু নির্মাণের পর থেকে খেয়ার যাত্রী কমে গেছে। এখন ঘাটে যে সংখ্যক যাত্রী পারাপার হয়, তার জন্য পাঁচ থেকে ছয়টি নৌকা হলেই যথেষ্ট। সেখানে প্রতিদিন ১৩টি নৌকা পারাপারের জন্য সিরিয়ালে থাকে। এ কারণেও খুব বেশি আয় হয় না। মাঝেমধ্যে যাত্রীরা নদীতে বেড়ানোর জন্য নৌকা ভাড়া করেন। তখন কিছু বাড়তি টাকা আয় হয়।
আলাপের একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর হোসেন, হানিফ মিয়া, সোমেদ আলী ও একরাম আলী পাশে এসে দাঁড়ান। দৈনিক আয় নিয়ে তাঁরাও হতাশার কথা বলেন। মাঝি জাহাঙ্গীর হোসেন (৪৫) বলেন, ভাগাভাগি করে নৌকা চালাতে গিয়ে দেখা যায়, একেকজন মাঝি সপ্তাহে মাত্র দুই-এক দিন করে নৌকা চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাঁরা নিয়মিত নৌকা চালাবেন, তাঁরা অন্যদের (যাঁরা নৌকা চালাবেন না) মাসে কিছু টাকা দেবে। এরপর থেকে ১৬ থেকে ১৭ জন নিয়মিত খেয়া পারাপার করছেন।
বলেশ্বর খেয়াঘাটের ইজারাদার মো. হিরা বলেন, মোরেলগঞ্জ উপজেলার মহিষপুরা, বোলপুর, চিংরাখালী, রামচন্দ্রপুর ও ঝিলবুনিয়া গ্রামের মানুষকে বলেশ্বর সেতু পার হয়ে অনেক পথ ঘুরে পিরোজপুর শহরে আসতে হয়। এ কারণে অনেকে বলেশ্বর খেয়া পার হয়ে কম সময়ে পিরোজপুর শহরে আসেন। তবে সেতুর কারণে খেয়া নৌকার যাত্রী অনেক কমে গেছে। খেয়ানৌকার মাঝিরা সামান্য আয় দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন।