কবিতা লেখেন, কবিরাজি করেন, আছে পেঁয়াজুর দোকান
‘স্বাধীনতা স্বাধীনতা/ ছাব্বিশে ভোর/ স্বাধীনতা স্বাধীনতা/ খোল সবে দোর...’ রোববার মহান স্বাধীনতা দিবসে গ্রামের একটি বটগাছের নিচে শিশুদের জড়ো করে নিজের লেখা এ কবিতা শোনাচ্ছিলেন স্বভাবকবি আফাজ উদ্দিন কবিরাজ।
এভাবে জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোয় কবিতা লিখে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষজনকে শোনান তিনি। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোকুল গ্রামে।
এই স্বভাবকবি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থাগুলো তাঁকে কবিতা পাঠেন আমন্ত্রণ জানায়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালায়ও সম্মানীর বিনিময়ে বিষয়ভিত্তিক কবিতা শোনান তিনি। পাঁচ শতাধিক কবিতা মুখস্থ রয়েছে তাঁর।
আফাজ উদ্দিনের বয়স এখন ৬৬ বছর। তিনি বলেন, পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। পাড়ার বারান্দার একটি পাঠশালায় লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। কৈশোরে বাড়ির পাশের বিলকুমারীর বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন মাছের আকাল। তাই গোকুল বাজারে পেঁয়াজু ও ডালপুরির ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছেন। কবিরাজি চিকিৎসাও করে থাকেন বলে নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে কবিরাজ।
কবিতার লেখার প্রসঙ্গ উঠতেই একটি ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন আফাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ২০ বছর আগে একদিন ছোট্ট একটি মেয়ে একটি ফুলের মালা বিক্রির জন্য তাঁর কাছে অনুনয়-বিনয় করেছিল। তখন হাতের ফুলের মালা এবং মেয়েটির মুখটি দেখে তাঁর মধ্যে কবিতার ভাব আসে। সেই শুরু। এর পর থেকে প্রায় ২০ বছর ধরে কবিতা-ছড়া লিখে আসছেন।
জাতীয় দিবস ছাড়াও করোনা মহামারি, পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহ, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তিসহ প্রকৃতি ও মানুষ উঠে এসেছে আফাজ উদ্দিনের কবিতায়।
স্বাধীনতা দিবসের দিন রোববার দুপুরে তানোরের গোকুল গ্রামে ওই কবিতার আসরে গিয়ে দেখা যায়, ২৫–৩০ জন শিশু–কিশোরী আফাজ উদ্দিনকে ঘিরে কবিতা শুনছে। কবিতা পাঠ করতে করতে একেকজনের কাছে যাচ্ছেন এই স্বভাবকবি। প্রথমেই শোনান, ‘স্বাধীনতার ভোর’ ও ‘অগ্নিঝরা দিন’ নামের দুটি কবিতা। এরপর তিনি একের পর এক কবিতা ও ছড়া শোনাতে থাকেন। বিলকুমারী বিল নিয়ে লেখা ছড়া, মাছ ও শর্ষে ফুল নিয়ে লেখা ছড়া।
মজার বিষয় হলো, ছড়াগুলো তাঁর মুখস্থ। একটি ছড়ার নাম ‘মাটির কামান’। এর প্রথম দুটি চরণ হলো, ‘রাস্তার ধারে খুকুমণি/ সেট করেছে মাটির কামান/ পুতুলেরে ডেকে বলে/ শেষ করে দাও শত্রু তামাম।’ কবিতা পাঠের আসর চলার একফাঁকে আফাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, যা দেখে তাঁর ভালো লাগে, তা নিয়েই কবিতা লেখেন।
বারসিক নামের একটি বেসরকারি সংস্থা তানোরের ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি আফাজ উদ্দিনকে সম্মানীর বিনিময়ে বিষয়ভিত্তিক কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে।
এ প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি কর্মকর্তা অমৃত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, আফাজ উদ্দিন একজন স্বভাবকবি। তিনি যেকোনো ছবি, বিষয় বা প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখতে পারেন। গ্রামে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে আবিষ্কার করেন তাঁরা। তাঁদের ১০টি বিদ্যালয়ে এবং প্রশিক্ষণ কর্মশালায় জীববৈচিত্র্যের ওপর কবিতা পাঠের জন্য আফাজ উদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। আফাজ উদ্দিনও ওই বিষয়ের ওপরে কবিতা লিখে নিয়ে যান। এতে তাঁদের কর্মশালাগুলো প্রাণবন্ত হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সাহিত্য নিয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
আফাজ উদ্দিনের এক মেয়ে ও পাঁচ ছেলে। এই প্রতিবেদক তাঁর বাসায় গেলে কথা হয় তাঁর স্ত্রী আঞ্জু আরার সঙ্গেও। তিনি বলেন, তাঁর স্বামীর ধ্যানজ্ঞান কবিতা। এখন দেশের মানুষ তাঁকে কবি হিসেবে মূল্যায়ন করলে ভালো লাগত।