ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে তিন বছর সাত মাস ধরে কোনো এক্স-রে প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে না। এ হাসপাতালে দুটি এক্স-রে যন্ত্রের একটি নষ্ট, আরেকটি সচল থাকলেও রেডিওলজিস্ট না থাকায় প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে না। যে এক্স-রে যন্ত্রটি সচল রয়েছে, তাতে এক্স-রে পরীক্ষা করলে শুধু প্লেট (এক্স-রে ফিল্ম) দেওয়া হয়। সেই প্লেট বাইরের কোনো ক্লিনিকে দেখিয়ে প্রতিবেদন নিতে হয়। ফলে ভোগান্তি এড়াতে রোগীরা বাইরের ক্লিনিকেই এক্স-রে করিয়ে নেন। এতে গরিব রোগীদের অনেক বেশি টাকা খরচ হয়ে যায়। নিম্নবিত্ত মানুষ তাঁদের চিকিৎসার আশ্রয়স্থল এই সরকারি হাসপাতালে এসে এভাবে বিপাকে পড়লেও কর্তৃপক্ষ এ বিষয় যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা যায়, নষ্ট হয়ে থাকা এক্স-রে যন্ত্র মেরামতসহ রেডিওলজিস্ট পদের পদায়ন চেয়ে সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাপরিচালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, টেকনিক্যাল ম্যানেজার (রিপেয়ার) নিমিউঅ্যান্ডটিসি (ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার) এবং মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানিকে অন্তত ১০ থেকে ১২ বার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালটি শহরের প্রাণকেন্দ্র ফরিদপুর পৌরসভার পাশে মুজিব সড়কের উত্তর দিকে অবস্থিত। ১৯১৭ সালে এ হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করে। শহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর থাকলেও তা প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্বের কারণে শহরবাসী চিকিৎসাসেবা নিতে জেনারেল হাসপাতালেই আগে আসেন।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতালে দুটি এক্স-রে যন্ত্র রয়েছে। এর একটি ডিজিটাল ও অপরটি অ্যানালগ। ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্রটি ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকে সেটি এভাবেই পড়ে রয়েছে। ওই যন্ত্রটি মেরামতের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা নিমিউঅ্যান্ডটিসি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এই এক্স-রে যন্ত্রের ওয়ারেন্টি ছিল পাঁচ বছর। গত বছর এ ওয়ারেন্টিও শেষ হয়ে গেছে। ডিজিটাল যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে থাকায় অ্যানালগ যন্ত্রে এক্স-রে করতে হচ্ছে। তবে তা প্লেটে ঠিকমতো দৃশ্যমান হয় না।
এক্স-রে মেশিনের দায়িত্বে নিয়োজিত ওই হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফি) মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, সর্বশেষ এই হাসপাতালে জুনিয়র কনসালট্যান্ট (রেডিওলজিস্ট) হিসেবে কর্মরত ছিলেন মাকসুদা খাতুন। ২০১৯ সালের ২৪ জুন তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পর থেকে এ হাসপাতালে এক্স-রে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে অনেক সময় রোগীদের দাবির মুখে এক্স-রে করে প্লেট ধরিয়ে দিতে হচ্ছে। তখন আবার বাইরে থেকেই ওই প্লেট দেখিয়ে এক্স-রে প্রতিবেদন আনতে হচ্ছে।
সরকার নির্ধারিত ফি অনুসারে এ হাসপাতালে কোনো রোগীর বুক ও পায়ের এক্স–রে করা হলে অ্যানালগে ৭০ টাকা এবং ডিজিটালে ২০০ টাকা লাগে। ওই একই এক্স-রে বাইরে ডিজিটাল মেশিন দিয়ে করতে রোগীদের গুনতে হয় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। হাসপাতালে রোগীর হাত ও পায়ের পাতা এবং কনুইয়ের এক্স-রে করতে হলে অ্যানালগে ৫৫ টাকা ও ডিজিটালে ১৫০ টাকা দিতে হয়। ওই এক্স রে বাইরে থেকে করতে হলে খচর পড়ে ৫০০ টাকা।
গত ২৩ জানুয়ারি সরেজমিনে বেশ কয়েকজন রোগীকে হাসপাতালে এক্স-রে করতে না পেরে ফিরে যেতে দেখা যায়। এক্স-রে মেশিনের নির্ধারিত কক্ষে দেখা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কর্মচারী বসে অলস সময় পার করছেন। ওই কক্ষে ঢুকলেই নজরে পড়ে, ‘এক্স-রে রিপোর্ট হয় না, শুধুমাত্র ফিল্ম দেওয়া হয়’ ঘোষণাটি একটি সাদা কাগজে লিখে মেশিনের সঙ্গে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিন অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন ফরিদপুরের সালথার আটঘর ইউনিয়নের খোয়াড় গ্রামের মাফিকুল ইসলাম (৩৪)। তিনি বলেন, তিনি বাবাকে বুকের এক্স-রে করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। হাসপাতালে এসে তিনি জানতে পারেন, মেশিন নষ্ট থাকায় এক্স-রে করা হয় না। পরে ৬০০ টাকা খরচ করে তিনি বাইরের একটি ক্লিনিকে বাবাকে নিয়ে গিয়ে ওই এক্স-রে করিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন মো. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট না থাকায় এবং ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি অচল হয়ে পড়ায় আমরা রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছি না। রোগীদের ভোগান্তি দেখতে আর ভালো লাগে না। নিজেদের খুব অসহায় মনে হয়।’
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা গণেশ কুমার আগরওয়ালা বলেন, গত সাড়ে তিন বছর ধরে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগে বারবার চিঠি দেওয়ার পর চলতি বছর ২৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্টের লাইন ডাইরেক্টর মো. মাজহারুল হক ও ওই প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার-ইসরাত জাহান উম্মন পরিদর্শনে আসেন। তাঁরা পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।