গা ছমছমে গুহায় যেন রহস্যের জাল পাতা; কোথায়, কীভাবে যাবেন
বাইরে থেকে গুহায় প্রবেশের মুখ দেখলেই গা ছমছম করে। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে হবে যেন অচিন কোনো এক রাজ্য। মশাল জ্বালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। সামনে যতই পা চালাবেন, ততই গা শিউরে উঠবে। তবে মন চাইবে আরও ভেতরে যেতে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে রথীচন্দ্র কারবারিপাড়া এলাকায় অবস্থিত এই গুহার নাম বাদুড়গুহা।
স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কাছে এই গুহার নাম ‘তকবাক হাকর’, অর্থাৎ বাদুড়গুহা। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকে একে দেবতার গুহাও বলেন। গুহার পাশে রয়েছে ছোট–বড় বেশ কয়েকটি ঝরনা। তবে এসব ঝরনার সৌন্দর্য দেখতে হলে যেতে হবে বর্ষার সময়। যাওয়ার পথে পরতে পরতে রয়েছে রোমাঞ্চ, আছে ঝুঁকিও। এসব ঝুঁকি পেরিয়ে যেতে পারলেই বাদুড়গুহা দর্শন করা সম্ভব। এই গুহায় সারা বছরই ভিড় করেন পর্যটকেরা।
দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের আটমাইল এলাকা হয়ে যেতে হয় বাদুড়গুহায়। উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে রথীচন্দ্র কারবারিপাড়ায় পৌঁছাতে সময় লাগবে ৩০ মিনিটের বেশি। এরপর কাঁচা মাটির সরু রাস্তা আর উঁচু পাহাড় বেয়ে নামতে হবে অন্তত ৫০০ ফুট নিচে। নিচের গভীর খাদে রয়েছে কালো পাথর। পাথরের গা বেয়ে নামছে পানি। তার পাশে রয়েছে ঝিরি। পাহাড় ভেদ করে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই গুহা দেখে হতবাক হবেন যে কেউ। ৩০ থেকে ৩৫ ফুট উঁচু গুহা। দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬৫ ফুট। প্রস্থ চার থেকে পাঁচ ফুট। গুহাজুড়ে অন্ধকার। গুহায় ঢুকতে হলে একমাত্র ভরসা মশাল কিংবা টর্চলাইট।
মশাল নিয়ে ভেতরে যেতেই চমকে দেবে গুহার ভেতরের শীতল পরিবেশ। কিছু দূর যেতেই গুহা আরও সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। তবে চোখ আটকে যাবে গুহার ওপরের অংশ দেখে। নিপুণ শিল্পীর মতো পাহাড়ের ওপরের খাঁজ কাটা। গুহাজুড়ে রয়েছে অসংখ্য বাদুড়ের আস্তানা। পুরো গুহা ঘুরে আসতে সময় লাগবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। গুহা থেকে বেরিয়ে এলে চোখে পড়বে ‘খুম’ বা জলাধার। পাহাড়ের জলপ্রপাত থেকে তীব্র শব্দে সেখানে নেমে আসে পানির স্রোত। স্বচ্ছ শীতল জল মুগ্ধ করবে যে কাউকে। শীতে পানির স্রোত কম হলেও বর্ষায় এটি ভরা থাকে।
এখানে ঘুরতে আসা পর্যটক আকতার হোসেন বলেন, ‘বাদুড়গুহার কথা জানতে পেরেছি স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে। গুহাটি প্রাকৃতিক। এখানে গিয়ে যে রোমাঞ্চ হলো, তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। গুহাটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। গুহায় যাওয়ার পথটিও অসাধারণ। আর স্থানীয় লোকজনের ব্যবহারও দারুণ। গুহায় যাতায়াতে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা পর্যটকদের গুহায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন।’
আটমাইল এলাকা থেকে বাদুড়গুহায় যেতে পথে চোখে পড়বে সবুজ ল্যান্ডস্কেপ আর নানা প্রজাতির পাখির কলরব। পথজুড়ে নীরবতা। মাঝে মাঝে দেখা যাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জুমঘর আর তাদের জীবনধারা। এমন সব দৃশ্য উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে নামার কষ্টটা ঠিক পুষিয়ে দেবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ঘনশ্যাম ত্রিপুরা বলেন, এই গুহা কবে সৃষ্টি হয়েছে, কেউ বলতে পারে না। এলাকার লোকজন এটাকে দেবতারা তৈরি করেছেন বলে ধারণা করেন। অনেকে এখনো গুহায় গিয়ে পূজা দিয়ে থাকেন। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এ গুহা দেখতে এলে তাঁকে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে না। স্থানীয় লোকজন সুন্দরভাবে গুহায় পর্যটকদের ঘুরিয়ে আনতে পারবেন।
সতর্কতা
ভ্রমণপিপাসুদের যেমন আকৃষ্ট করে এই গুহা তেমনি সেখানে যেতে দরকার কিছু সতর্কতাও। আগেই বলে রাখি, শারীরিকভাবে সক্ষম কিংবা যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার করেন, তাঁদের জন্য এই জায়গা। বর্ষাকালে এই স্থান ভ্রমণের উপযোগী থাকে না। শারীরিকভাবে সক্ষম না হলে বাদুড়গুহায় না যাওয়াই ভালো। বাদুড়গুহায় যেতে হলে অবশ্যই আগে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। এই এলাকায় যেতে স্থানীয় লোকজনের সহায়তা নিতে হবে। সঙ্গে নিতে হবে পর্যাপ্ত পানি, শুকনা খাবার, আলাদা পোশাক, রশি; হাঁটার জন্য সহায়ক লাঠি থাকতে হবে। প্রয়োজনে নেওয়া যেতে পারে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম। পাহাড়ে হাঁটার উপযোগী জুতা, গুহায় প্রবেশের জন্য টর্চলাইট অবশ্যই সঙ্গে নিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার–পানি সঙ্গে রাখলে ভালো।
মানতে হবে কিছু নিয়মকানুন
তকবাক হাকর বা বাদুড়গুহায় যেতে হলে মানতে হবে কিছু নিয়মকানুন। ছবি তোলার সময় অবশ্যই অনুমতি নিয়ে তুলতে হবে। চিৎকার-চেঁচামেচি আর সাউন্ড বক্সে গান বাজানোর জায়গা নয় এটি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। যেকোনো ভ্রমণেই সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের সংস্কৃতি ও রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত।