একদিন চাম্পাতলীর মারমাপাড়ায়

বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দূরেই চাম্পাতলী মারমাপাড়া
ছবি: প্রথম আলো

চাম্পাতলী মারমাপাড়ার চা–দোকানি ই থুই চিং। এক আষাঢ়ে সন্ধ্যায় তাঁর দোকানে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন। ছোট্ট টংদোকানটিতে লম্বা একটি টেবিলের দুই দিকে টুল বসানো। সেখানে স্বল্প আলোয় ভেতরে খোশগল্পে মজে আছেন পাড়ার নারী-পুরুষ, বেশির ভাগই অবশ্য নারী। দোকানিও নারী বলেই হয়তো এমনটি হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের সামনে ধূমায়িত চা। বাইরে তখন অল্পস্বল্প বৃষ্টি।

আমরা দোকানে ঢুকতেই তাঁরা উঠে গেলেন। ইশারায় বসার আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা ইতস্তত করছিলাম। তাই দেখে একজন সবিনয়ে বললেন, ‘আপনারা অতিথি। আমরা তো প্রতিদিন এখানে বসি।’ সারা দিন লামার পাহাড়-বন ঘুরে ঘুরে কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম আমরা। তা ছাড়া গরুর দুধের ধূমায়িত চায়ের লোভে বসে পড়াই শ্রেয় মনে হলো।

খুব দ্রুত চা পরিবেশন করা হলো। পাশাপাশি দোকানে ঝুলিয়ে রাখা কাঁদি থেকে ছিঁড়ে কলাও খেতে দিলেন ই থুই চিং। পাহাড়ি বাংলা কলা, ছোট, কিন্তু অতুলনীয় স্বাদ। জানতে চাইলাম কলার দাম। তিনি জানান, জোড়া ছয় টাকা। এত কম কেন জানতে চাইলে ই থুই চিং ঝটপট উত্তর দিলেন, ‘এটা তো কিনতে হয়নি। আমাদের উঠানেই ফলেছে।’ বর্তমানে দেশের বাজার পরিস্থিতি আর ব্যবসাপাতির জটিল হিসাব–নিকাশ ছাপিয়ে ধূমায়িত চায়ের মতো সহজ-সরল দোকানির এমন উষ্ণ মমতা আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। সেদিনের সন্ধ্যার আড্ডাটা তাই জমে গেল নানা সুখ–দুঃখের ভাব বিনিময়ে।

ই থুই চিং চাম্পাতলী মারমাপাড়ার বাসিন্দা। বান্দরবান জেলার লামা উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ২ একর আয়তনের ছোট্ট পাড়াটিতে তাঁর মতো আরও প্রায় ৪০০ জনের বাস। এটি লামা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড। পৌরসভা হলেও পুরো পাড়া ঘুরে শহরের কোনো চিহ্ন আমাদের চোখে পড়ল না। বরং দেখা গেল বেশ কয়েকটি জরাজীর্ণ ঘর।

মারমাপাড়ার ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলো
ছবি: প্রথম আলো

মারমাপাড়ায় মোট পরিবারের সংখ্যা ৬২টি। এই পাড়ায় শুধু মারমারাই থাকে। তবে পাড়ার উত্তর ও পশ্চিম পাশে বাঙালিপাড়া আছে। পাড়ার উত্তরে চাম্পাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাড়ার মাঝখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত চাম্পাতলী পাড়াকেন্দ্র।

মারমাপাড়ায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম ওদের ঐতিহ্যবাহী থাকার ঘরগুলো। মাটি থেকে ওপরে মাচার মতো ঘরগুলো বাঁশ, কাঠ, শণ ও টিনের তৈরি। এসব ঘরে কাঠের সিঁড়ি অথবা বাঁশের মই দিয়ে উঠতে হয়। তবে ইদানীং কিছু কিছু পাকা ঘরও উঠছে। লামার সাংবাদিক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানান, মারমাপাড়ার অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বহু বছর ধরে ওদের কৃষ্টি–সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ধরন যা ছিল, তা এখন বদলে যাচ্ছে। পুরোনো মাচাঙের মতো ঐতিহ্যবাহী ঘর ভেঙে যাওয়ার পর আর কেউ ওভাবে ঘর বাঁধছেন না। সমতলের মতো কাঠামো করেই ঘর বাঁধছেন।

চাম্পাতলী মারমাপাড়ার চা–দোকানি ই থুই চিং
ছবি: প্রথম আলো

আলাপে আলাপে জানা গেল, এ পাড়াতেও পানির সংকট। এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। তবুও বেকার রয়েছেন অনেকেই। পাড়া কার্বারি চাথোয়াই মার্মা বলেন, পাড়ার দক্ষিণ পাশে ১২ আনসার ব্যাটালিয়ন এর সদর দপ্তর। ওই দপ্তরে আসা–যাওয়ার একমাত্র পথ চাম্পাতলী সড়ক। সড়কটি পাড়ার মাঝখানে। মানুষের ঘরবাড়ির সঙ্গে লাগোয়া। আগেও এই সড়ক ছিল। তবে বছর দু-এক আগে আনসারের দপ্তরে সুউচ্চ সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার পর সাধারণ মানুষের বিকল্প অনেক পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে পাড়ার ভেতর দিয়ে মানুষের যাওয়া–আসা বেড়ে গেছে। একসময়ের নির্জন চুপচাপ পাড়ার নিভৃত পরিবেশটা ভেঙে গেছে। পাড়ার বাইরে দিয়ে যাতায়াতের জন্য নতুন রাস্তা নির্মিত হলে তাঁদের সুবিধা হয়।