শ্রমিক থেকে জুতা কারখানার মালিক তিনি
আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে কয়েক দফা পেশা বদল করেও সংসারের অভাব ঘোচাতে পারছিলেন না মজনু সরকার (৪৫)। সর্বশেষ ঢাকায় গিয়ে একটি জুতার কারখানায় বছরখানেক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। এলাকায় ফিরে নিজেই এখন জুতা তৈরির কারখানার মালিক হয়ে গেছেন।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বাসিন্দা মজনু সরকার। গুরুদাসপুর পৌরসভার চাঁচকৈড় বাজারপাড়া মহল্লায় একটি ভাড়া বাসায় গড়ে তুলেছেন তাঁর জুতার কারখানা। স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও নিজের কারখানায় কাজ করছেন ছয়জন শ্রমিক। তাঁর তৈরি করা জুতা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার হাট-বাজারের দোকানগুলোতে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে।
মজনু সরকার বলেন, কারখানা পরিচালনা করে সব খরচ বাদে মাসে অন্তত ৩০ হাজার টাকা লাভ থাকছে তাঁর। এতে সংসারে তাঁর সচ্ছলতা ফিরেছে। তবে পুঁজি সংকটের কারণে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো যাচ্ছে না। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর ইচ্ছা আছে।
গত বুধবার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, মজনু সরকার বসে জুতার জোড়া মিল করছেন। এ কাজে স্ত্রী তাঁকে সহযোগিতা করছেন। পাশে ছেলে জিহাদ চাপ মেশিনে জুতা কাটছেন। সেখানে নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় মজনু সরকারের সঙ্গে।
মজনু বলেন, জমানো ৮০ হাজার টাকা দিয়ে জুতা তৈরির কারখানা শুরু করেছেন। এ উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘জিহাদ সুজ’। বাজারে চাহিদা থাকায় মাত্র ৯ মাসের মাথায় ব্যবসায় আরও এক লাখ টাকা বিনিয়োগ বাড়াতে হয়েছে। সেই সঙ্গে মাসিক ৪ হাজার টাকা ভাড়া বাসায় কারখানা স্থানান্তর করতে হয়েছে। সেখানে পরিবারের পাঁচ সদস্য ও ছয়জন শ্রমিকের থাকার ব্যবস্থা আছে। শ্রমিকদের বেতন ৪-৫ হাজার টাকা করে। তবে ব্যবসায় পুঁজি বাড়ানো গেলে আরও বেশিসংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।
চাঁচকৈড়ের কয়েকজন জুতা ব্যবসায়ী বলেন, মজনুর তৈরি জুতাগুলো মানসম্পন্ন ও আকর্ষণীয় হওয়ায় ক্রেতা চাহিদা রয়েছে। তা ছাড়া নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে তাঁকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করছেন তাঁরা।
মজনু সরকারের বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি শ্রমিক। সংসার চালাতে বাবাকে সহযোগিতা করার কারণে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি মজনু। পরে পেশা বদলিয়ে মোবাইল সার্ভিসিংয়ে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। এ কাজেও মন না বসায় ঢাকায় গিয়ে জুতা কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন নিজেই উদ্যোক্তা হয়েছেন। নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছেন মজনু। তিনি বলেন, শুরুটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। ধৈর্য ধরে এ পেশায় যুক্ত আছেন। পরিবারের সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন। বাজারে এখন বেশ সাড়া পাচ্ছেন। ‘জিহাদ সুজ’-এর জুতা বাংলাদেশের সব জায়গায় পৌঁছে দিতে চান তিনি।
মজনুর জুতা কারখানা দেখতে এসেছিলেন মাসুদ রানা নামের এক যুবক। অল্প পুঁজিতে এমন কারখানা দেখে তিনি বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মাসুদ বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে একটি কারখানা গড়ে নিজে বেকারত্ব ঘুচিয়ে অন্যদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার তাঁরও ইচ্ছা আছে।
শুরুটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। ধৈর্য ধরে এ পেশায় যুক্ত আছেন। পরিবারের সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন।
জুতা তৈরির প্রক্রিয়া বিষয়ে মজনু সরকার বলেন, তিনটি মেশিনে তিন ধাপ কাজ শেষে স্লিপারগুলো বিক্রির উপযোগী করা হয়। প্রথমে ঢাকা থেকে আসা উপকরণগুলো কাটিং মেশিনের সাহায্যে ছোট–বড় বিভিন্ন আকৃতিতে কাটা হয়। বাড়তি টেকসই করতে লেস লাগিয়ে হাতে সেলাই করা হয়। এরপর আকর্ষণীয় করতে প্রিন্ট মেশিনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লোগোসহ নানান ডিজাইনের প্রিন্ট করা হয়। প্রিন্ট শেষে আঠা লাগিয়ে শুকিয়ে জোড়া লাগানো হয়। চাপ মেশিনের মাধ্যমে দুটি অংশের জোড়াকে আরও শক্ত ও মজবুত করা হয়। শেষ ধাপে ফিনিশিং মেশিনের মাধ্যমে বাজারে বিক্রির উপযোগী করে জুতা প্যাকেটজাত করা হয়। জনবল না থাকায় নিজেই দোকানে দোকানে ঘুরে জুতার অর্ডার সংগ্রহের পর চাহিদামতো সরবরাহ করে থাকেন। মাসে ৩৫০ থেকে ৪৫০ ডজন স্লিপার জুতা তৈরি করতে পারেন তিনি।
গুরুদাসপুর পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী বলেন, মজনু সরকার একজন সফল ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোক্তা। তাঁর কারখানায় উৎপাদিত জুতাগুলোর গুণগতমান ভালো। এখানে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। তাঁর এ সাফল্য অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে।