হবিগঞ্জের লাখাইতে কাবিখার কাজ না করেই টাকা ‘খাওয়া’ শেষ 

২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার ৯টি প্রকল্পের মধ্যে একটিতে কাজ হয়েছে। বাকি আটটিতে কাজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার করাব ইউনিয়নের পিআইও সেতু থেকে আগাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সড়কটি সংস্কার দেখিয়ে কাবিখার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

কর্মসূচির নাম কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা)। হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় বরাদ্দ এসেছিল ৫৯৪ মেট্রিক টন চাল। এর ভিত্তিতে ৯টি প্রকল্প নেয় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। কাগজে-কলমে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। বিনিময়ে বরাদ্দ বাবদ প্রায় ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে আটটি প্রকল্পেই কোনো কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

নীতিমালা অনুযায়ী কাবিখা কর্মসূচি (সাধারণ) প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সহসভাপতি এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সদস্যসচিব। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এ প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউএনও একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দাবি, কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি।

ইউএনও ও পিআইও কার্যালয়ে সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে মুড়িয়াউক, বামৈ, বুল্লা ও করাব ইউনিয়নে ৯টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সদর ও মোড়াকরি ইউনিয়নে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। গত শনিবার (২৮ এপ্রিল) সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে ৯টি প্রকল্পের মধ্যে কেবল মুড়িয়াউক ইউনিয়নের তেঘরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার মাঠে উন্নয়নকাজ হয়েছে। বাকি আটটি প্রকল্পের অধীনে কাজের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এলাকার মানুষেরাও প্রকল্পের অধীনে কোনো কাজ হতে দেখেননি।

করাব ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শিমুল বাড়ি পিআইও ব্রিজ থেকে আগাপুর বিদ্যালয় পর্যন্ত যে রাস্তা দেখানো হয়, সেটিও গ্রামের অনেক পুরোনো। সরেজমিন রাস্তা সংস্কারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। গ্রামবাসীও রাস্তায় কোনো কাজের কথা জানেন না।

বাস্তবে যা পাওয়া গেল

করাব ইউনিয়নের আগাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে হরিণকোনা বেলেশ্বরী নদীর পিআইও ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের একটি প্রকল্প ছিল। সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তাটি গ্রামের ২৫ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো মাটির একটি রাস্তা। আগাপুর গ্রামের বাসিন্দা গোপাল সরকার ও রাজেন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় এক বছর আগে গ্রামবাসীর অর্থে ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তার কিছু ভাঙা স্থান ও গর্ত ভরাট করা হয়। খবর পেয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুশফিউল আলম তাঁদের ডাকেন। তিনি ৪ লাখ টাকা দিয়ে বলেন, তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে রাস্তা সংস্কারের জন্য এই টাকা দিয়েছেন। গ্রামবাসী ছাড়া এ রাস্তার মেরামত আর কেউ করেনি।

হরিণকোনা গ্রামের দেবেন্দ্র সরকার ও যতিন সরকার বলেন, গ্রামের রাস্তার পাশে সুন্দর খাল রয়েছে। প্রায় দুই বছর আগে গ্রামবাসী খালটি খনন করে মাটি রাস্তার পাশে ফেলেন। এ কাজের পরে উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রামবাসীকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে বলেছিলেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে এ টাকা দিয়েছেন। এ কাজ ছাড়া গত পাঁচ বছরেও আর কোনো কাজ হয়নি।

করাব ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শিমুল বাড়ি পিআইও ব্রিজ থেকে আগাপুর বিদ্যালয় পর্যন্ত যে রাস্তা দেখানো হয়, সেটিও গ্রামের অনেক পুরোনো। সরেজমিন রাস্তা সংস্কারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। গ্রামবাসীও রাস্তায় কোনো কাজের কথা জানেন না।

এই দুই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি করাব ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামবাসীর অভিযোগ ঠিক না। উপজেলা চেয়ারম্যান এ এলাকার অভিভাবক। তাঁর পরামর্শক্রমে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে দেড় বছর আগে কাজ করিয়েছেন। এর মধ্যে একটা বন্যা হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময়ের কারণে রাস্তার ক্ষতি হতে পারে।

মুড়িয়াউক ইউনিয়নের তেঘরিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের টমটম স্টেশন থেকে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নুরধন মিয়ার বাড়ির সামনে হয়ে সুনেশ্বর পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প দেখানো হয়েছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা শামছুদ্দিন বলেন, ‘চার-পাঁচ মাস আগে আমরা দেখছি ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে রাস্তার পাশের নালা পরিষ্কার করে এর মাটি তুলে রাস্তার কিছু অংশে ফেলা হয়েছে। এর বেশি কোনো কাজ করতে আমরা দেখিনি।’ একই ইউনিয়নের লখনাক থেকে সাতাউক পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য রাস্তায়ও কয়েকটি স্থানে কিছু মাটি ফেলে প্রকল্প সম্পন্ন দেখানো হয় বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা।

প্রকল্পের সভাপতি মুড়িয়াউক ইউপি চেয়ারম্যান নোমান সারোয়ার দাবি করেন, আবহাওয়াজনিত সমস্যায় এ প্রকল্পের কাজ করতে তাঁর বিলম্ব হয়েছে। তবে তিনি শতভাগ করেছেন। হয়তো বর্ষা ও বৃষ্টির কারণে রাস্তার ক্ষতি হয়েছে।

বামৈ ইউনিয়নের বামৈ গ্রামের কেলু মিয়ার বাড়ির পিচ রাস্তা থেকে ভাদিকারা হাবিব মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত একটি রাস্তা এবং বামৈ গরুর বাজার পিচ রাস্তা থেকে নয়াগাঁও সুতাং নদ পর্যন্ত একটি রাস্তা প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে। সরেজমিনে গেলে এলাকাবাসী জানান, গত দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে রাস্তা দুটিতে কোনো কাজ হয়নি। ভুয়া প্রকল্প দেখানোর কারণে সাবেক ইউপি সদস্য ইকবাল মিয়া গত ৩ মার্চ হবিগঞ্জ বিশেষ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। আদালত মামলাটি দুদককে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রকল্প দুটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি বামৈ ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও তৎকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাঁকে এ দুই প্রকল্পের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দিতে বলেছিলেন। তিনি তাঁদের কথামতো কমিটি দেন। এরপর আর কিছু জানেন না।

বুল্লা ইউনিয়নের নেওয়া দুটি প্রকল্পেরও কাজের কোনো আলামত বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইউপি চেয়ারম্যান খোকন চন্দ্র গোপ দাবি করেন, তিনি এ কাজ বাবদ ১৪০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পান। তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করিয়েছেন। এ এলাকা প্রত্যন্ত ভাটি অঞ্চল হওয়ায় গত বর্ষায় রাস্তাঘাট ডুবে যায়। পাশাপাশি রাস্তার ওপর দিয়ে নৌকা চলাচল করার কারণে রাস্তার ক্ষতি হয়েছে।

দায় নিচ্ছেন না কেউ

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আলী নূর গত বছরের ১৬ নভেম্বর লাখাই থেকে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় বদল হয়ে চলে যান। অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বরাদ্দটি মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আবু জাহির অনুমোদন করে নিয়ে আসেন। এ কাজের ছাড়পত্র দিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। চাহিদার চেয়েও বেশি কাজ হয়েছে এ উপজেলায়। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হয়নি। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে প্রকল্পটি নিয়ে নানা অপপ্রচার হচ্ছে।

এ কাজের দায়দায়িত্ব ইউএনও ও পিআইওর বলে দাবি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুশফিউল আলমের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা বিলে স্বাক্ষরের পর আমার স্বাক্ষর নিয়েছেন। কাজ না হয়ে থাকলে তদন্ত হলে তাঁরাই ফাঁসবেন। তবে আমি যতটুকু জানি, প্রকল্পের কাজ সবই হয়েছে। সমস্যা হলো, যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা শ্রমিক দিয়ে এ কাজ না করে মাটি কাটার মেশিনে সম্পন্ন করেছেন।’ গ্রামবাসীকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গ্রামের লোকজন যখন নিজেরা টাকা তুলে এ কাজ করছিলেন, তখন আমি তাঁদের ডেকে অবগত করি, এ রাস্তাগুলো ইউনিয়ন পরিষদ প্রকল্পে নিয়েছে। তাঁরা কেন শুধু শুধু টাকা খরচ করবেন।’

অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও নাহিদা সুলতানা বলেন, পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। তাঁরা কাজগুলো কীভাবে ছাড়পত্র দিয়েছেন, তাঁরাই এর উত্তর দেবেন।