জাকসুতে ৩৩ বছর পর নির্বাচন, হলের সব পদে প্রার্থীই মিলছে না
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন আগামী ১১ সেপ্টেম্বর। একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি আবাসিক হলেও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে জনবল ও প্রার্থীর সংকট, হল রাজনীতিতে অনীহাসহ বিভিন্ন কারণে কোনো সংগঠন এসব হলে সব পদে প্রার্থী দিতে পারেনি। হলগুলোতে স্বতন্ত্রভাবে অনেকে নির্বাচন করছেন। তাঁদের দলে ভেড়াতেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো। তবে তাতে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। ফলে দীর্ঘ ৩৩ বছর পর হতে যাওয়া এই নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১টি আবাসিক হল রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদের ১১টি ও ছাত্রীদের ১০টি হল। এসব হলে হল সংসদ নির্বাচনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিটি হলে ১৫টি করে পদ রয়েছে। হলগুলোতে সব পদে কোনো ছাত্রসংগঠন প্রার্থী দিতে পারছে না। তবে ছাত্রদল ছাত্রদের তিনটি হলে প্যানেল দিতে পারে বলে জানা গেছে।
গত সোমবার জাকসু নির্বাচনের খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। জাকসুর ২৫টি পদের বিপরীতে ২৫৬ জন প্রার্থীর নাম খসড়া প্রার্থী তালিকায় রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি আবাসিক হলের হল সংসদ নির্বাচনের জন্য খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিটি হলের ১৫টি করে পদ হিসেবে মোট ৩১৫টি পদের বিপরীতে ৪৮১ জন প্রার্থীর নাম তালিকায় রয়েছে। জাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ও ইসলামী ছাত্রশিবির ভিন্ন নামে প্যানেল ঘোষণা করেছে। এর বাইরে ছাত্রদল ও বামপন্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে থেকে আরও তিনটি প্যানেল ঘোষণা হতে পারে শিগগিরই। তবে জাকসুতে এসব সংগঠনের প্যানেল থাকলেও হল সংসদ নির্বাচনে তারা কেউই প্রতিটি পদে প্রার্থী দিতে পারছে না।
সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ও গেস্টরুম, গণরুম সংস্কৃতির জন্য হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের দলীয় রাজনীতিতে অনীহা রয়েছে। এ ছাড়া সংগঠনগুলো থেকে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরা সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদের বাইরে অন্যান্য পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী নন। ফলে তাঁরা সব পদে প্রার্থী দিতে পারছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি আবাসিক হলের মধ্যে কোনো হলেই ১৫টি পদে প্রার্থী দিতে পারছে না ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থী সংগঠনগুলো। সম্প্রতি জাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে প্যানেল ঘোষণা করেছে ছাত্রশিবির। তবে হলগুলোতে প্রার্থী ও জনবলসংকটের কারণে তারা কোনো হলেই ওই নামে প্যানেল দিতে পারছে না। কিন্তু ছাত্রদের কয়েকটি হলের কয়েকটি পদে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর ছাত্রীদের ১০টি হলের কোনো হলেই তাদের প্রার্থী নেই বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মুহিবুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রদের হলগুলোতে আমাদের সংগঠনের প্রার্থীরা নির্বাচন করছেন। তবে ছাত্রী হলগুলোতে ছাত্রী সংস্থার কোনো প্রার্থী নেই। কিছু প্রার্থী রয়েছে, যাদের আমাদের প্যানেল সমর্থন দেবে।’
প্রায় একই অবস্থা গণ-অভ্যুত্থানের পর গড়ে ওঠা ছাত্রদের সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের। ইতিমধ্যে তারা জাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ নামে প্যানেল ঘোষণা করলেও হলগুলোতে তারা ওই প্যানেলে প্রার্থী দিচ্ছে না। সংগঠনটির সূত্র জানায়, হলগুলোতে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কয়েকজন নেতা-কর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ছাত্রীদের কোনো হলেই তাদের ভিপি ও জিএস পদে প্রার্থী নেই। তবে হলগুলোতে স্বতন্ত্রভাবে যাঁরা নির্বাচন করছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক প্রার্থীকে তাঁরা দলে ভেড়াতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘সব হলে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সব হলেই আমাদের নেতা-কর্মী এবং সমর্থিত প্রার্থী রয়েছেন। ছাত্রদের ৬ থেকে ৭টি হলে ভিপি, জিএসসহ শীর্ষ পদে আমাদের প্রার্থী রয়েছেন।’
জাকসুতে নির্বাচনের জন্য ছাত্র ইউনিয়ন একাংশ (অদ্রি-অর্ক), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (একাংশ), জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও আন্দোলনসহ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে বামপন্থী সংগঠনগুলোর ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ নামে আলাদা একটি প্যানেল হতে পারে। তবে অভ্যন্তরীণ নানা হিসাব-নিকাশের কারণে এখনো জাকসু নির্বাচনেরই প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি তারা। সংগঠনটির সূত্রে জানা যায়, কোনো হলে তারাও প্রতিটি পদের বিপরীতে প্রার্থী দিতে পারছে না। তবে কয়েকটি হলে তাদের সমর্থিত কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনে লড়ছেন।
এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের একাংশের সভাপতি অদ্রি অংকুর বলেন, ‘আমরা হলগুলোতে প্যানেল দিচ্ছি না। তবে আমাদের সংগঠনের অনেকে ইনডিভিজুয়ালি বিভিন্ন হলে নির্বাচন করবেন।’
এর বাইরে ছাত্র ইউনিয়ন আরেকাংশ (জাহিদ-তানজিম), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (মাহফুজ), জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারসহ কয়েকটি সংগঠন মিলে আরেকটি প্যানেল হতে পারে। তবে প্রার্থী সংকটের কারণে তারা জাকসু নির্বাচনেই ২৫টি পদে প্রার্থী দিতে পারছে না। সুতরাং হল সংসদ নির্বাচনে দুয়েকটি হলের বাইরে কোনো হলেই তাদের কোনো প্রার্থী থাকবে না বলে জানা গছে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশিদের নেতৃত্বে আরেকটি স্বতন্ত্র প্যানেল হতে পারে। তবে তাঁরাও হল সংসদে কোনো প্যানেল দিচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
ছাত্রী হলে ভোট ছাড়াই জয়ী হবেন অনেকে
গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ২১টি আবাসিক হলের খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হলভিত্তিক খসড়া প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ছাত্রীদের ১০টি হলে মোট ১৫০টি পদের বিপরীতে ১৩৭ জন প্রার্থী রয়েছেন। প্রতিটি হলের ১৫টি পদের বিপরীতে ১৫ জনের কম প্রার্থী রয়েছেন ৪টি হলে। আর ১৫ জন করে প্রার্থী রয়েছেন দুটি হলে। অর্থাৎ এসব হলে অনেক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। এর মধ্যে নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে ভিপি, জিএসসহ মাত্র ছয়টি পদে একজন করে প্রার্থী রয়েছেন। ফলে ভোট ছাড়াই এসব প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। এ ছাড়া ১৫ নম্বর ছাত্রী হল, প্রীতিলতা হল, ফজিলাতুন্নেছা হল, বেগম সুফিয়া কামাল হলে ভিপি পদে মাত্র একজন করে প্রার্থী রয়েছেন। ফলে এসব হলেও ভোট ছাড়া ভিপি নির্বাচিত হবেন।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্য ও জীববিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব পদে একজন করে প্রার্থী রয়েছেন অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেসব পদে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণার দিন তাঁদের বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।’