বর্জ্যে ভরাট হচ্ছে কোদালীছড়া

পৌর কর্তৃপক্ষ শ্রমিক দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করলেও বর্জ্য ফেলা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কোদালীছড়ার মধ্যে নালার বর্জ্য পড়ছে। গত সোমবার সকালে মৌলভীবাজার শহরের উত্তর কলিমাবাদেছবি: প্রথম আলো

কোদালীছড়া মৌলভীবাজার শহরের পানিনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম, ‘হার্ট লাইন’। পাহাড় বর্ষিজোড়ার পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা শহরের পানি এই কোদালীছড়া দিয়ে বেরিয়ে হাইল হাওরে গিয়ে মেশে। কিন্তু অবাধ পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে কোদালীছড়াকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোদালীছড়ার শহর অংশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়ির নানা রকম বর্জ্য ফেলছেন অনেকে।

ওই বর্জ্যে কোদালীছড়ার বিভিন্ন স্থান ভরাট হয়ে উঠছে। কোদালীছড়ায় বর্জ্য না ফেলতে ছড়ার দুই পারের বসতির লোকজনের মধ্যে পৌরসভার উদ্যোগে প্রচার চালানো হয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ শ্রমিক দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করলেও বর্জ্য ফেলা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বর্ষায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে শহরে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গতকাল সোমবার শহরের কোদালীছড়ার পূর্ব সুলতানপুর, আরামবাগ, উত্তর কলিমাবাদ, ফাটাবিলসহ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোদালীছড়ার বিভিন্ন অংশে চিপস, বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্যের রাংতার প্যাকেট, বাজার-সদাই করার বিভিন্ন রঙের ও আকারের পলিথিন, পলিথিনের ছোট-বড় প্যাকেট, ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের কাপ-প্লেট, বোতলসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী, ঘর-গেরস্তালির বিভিন্ন বর্জ্য ফেলে রাখা হয়েছে। এগুলো কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে ছড়ানো-ছিটানো।

কোথাও খালের মধ্যে স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে। পানি কম থাকায় এসব বর্জ্য খালের কাদামাটিতে, জলজ ঘাসে, শুকনো স্থানে আটকে আছে, পড়ে আছে। স্থানগুলো ভরাট হচ্ছে। অন্যদিকে শহরের বিভিন্ন এলাকার পানিনিষ্কাশনের নালা (ড্রেন) কোদালীছড়ার যেখানে এসে মিশেছে, সেখানেও ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্যের স্তূপ জমে আছে।

শহরের বিভিন্ন স্থানে খোলা নালার মধ্যে ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সেসব বর্জ্য পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসে এসে কোদালীছড়াতে পড়ছে। কোদালীছড়া এখন শুকনো, পর্যাপ্ত পানি নেই। ফলে যেখানে এসে নালার বর্জ্য পড়ছে, যেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সেখানেই তা আটকে থাকছে। বর্ষার পুরো সময় এসব বর্জ্য পানির স্রোতে ভেসে হাইল হাওরে গিয়ে পড়ে। হাওরে দূষণ ঘটছে, হাওরও বর্জ্যে ভরে উঠছে। কিছু বর্জ্য হাইল হাওর থেকে গোপলা নদী হয়ে আরও ভাটির দিকে ভেসে যাচ্ছে।

মৌলভীবাজার পৌর কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার শহরের পূর্ব প্রান্তে বর্ষিজোড়া পাহাড়। বর্ষিজোড়া পাহাড় থেকে কোদালীছড়া বেরিয়ে মৌলভীবাজার শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর এটি গিয়ে পশ্চিমে হাইল হাওরের সঙ্গে মিশেছে। কোদালীছড়া ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার অংশ মৌলভীবাজার পৌর শহর এলাকায়। বাকি অংশটুকু শহরের বাইরে সদর উপজেলার মোস্তফাপুর, গিয়াসনগর ও নাজিরাবাদ ইউনিয়নে পড়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কাজ না করায় কোদালীছড়া একসময় ভরাট হয়ে যায়। শহরে জলাবদ্ধতা কাটাতে মাঝেমধ্যে সংস্কার হয়েছে, তবে তা খুব একটা কাজে আসেনি। ভারী বর্ষণ হলেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, সড়ক ও বাসাবাড়ি নোংরা পানিতে তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ২০১৮ সালে পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে কোদালীছড়া খনন করা হয়। সংস্কারের পর থেকে শহরের কোনো অংশে আর দীর্ঘ সময়ের জলাবদ্ধতা তৈরি হয়নি।

কোদালীছড়ার পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে পৌরসভার উদ্যোগে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান চালানো হচ্ছে। খালটি পরিষ্কার থাকায় বৃষ্টি হলেই শহরের পানি দ্রুত বের হয়ে যেতে পারছে। কোথাও জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে না। এদিকে কোদালীছড়ার উন্নয়নে প্রায় ২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গাইড ওয়াল নির্মাণ, কোদালীছড়ার দুই পারে ওয়াকওয়ে তৈরিসহ সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হচ্ছে। বর্তমানে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে।

পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শহরের সব বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য নিয়ে আসার ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বাসাবাড়ির বর্জ্য নিয়ে আসেন। তা সত্ত্বেও অনেকে নালার মধ্যে পলিথিন, গৃহস্থালির বর্জ্য, দোকান ও বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলছেন। শহরের যেকোনো নালাতে বর্জ্য ফেলা হলে পয়োনিষ্কাশন ও বৃষ্টির পানির সঙ্গে সেই বর্জ্য কোদালীছড়াতে এসে পড়ছে। আবার অনেকে কোদালীছড়াতেও সরাসরি বর্জ্য ফেলছেন। এতে কোদালীছড়া আবারও ভরাট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পৌরসভার পক্ষ থেকে কোদালীছড়ার দুই পাশের বাসাবাড়িতে কোদালীছড়ায় বর্জ্য না ফেলতে প্রচারণা চলানো হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা লোকচক্ষুর আড়ালে হুট করে বর্জ্য ফেলে দিচ্ছেন। দুই পারের বহুতল ভবনের ওপর থেকেও নিচে কোদালীছড়ার মধ্যে বর্জ্য ছুড়ে ফেলা হয়। এ অবস্থা শহরের প্রেসক্লাব-সংলগ্ন এলাকা থেকে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল সড়কের কোদালীপুল পর্যন্ত। এতে কোদালীছড়া পরিষ্কার রাখা, ভরাট হওয়া রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোদালীছড়ার শহর-শহরতলির অংশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে একজন সুপারভাইজার এবং সাতজন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন।

মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোদালীছড়া হচ্ছে শহরের হার্ট লাইন। কোদালীছড়া বাঁচলে শহর বাঁচবে। শহর রক্ষা করতে কোদালীছড়াকে বাঁচাতে হবে। না হলে শহরে আগের মতো জলাবদ্ধতা হবে। মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।’

মেয়র আরও বলেন, ‘আমরা কোদালীছড়ায় বর্জ্য না ফেলতে লিফলেট বিতরণ, প্রচার, মাইকিং করেছি। কিন্তু অনেকেই তা শুনছেন না। কোদালীছড়া নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে পৌরসভার মাসে লাখ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। বর্জ্য না ফেললে আমরা এই টাকাটা অন্য খাতে ব্যবহার করতে পারতাম। সব নাগরিক সমান সচেতন না হলে জলাবদ্ধতা থেকে শহরকে রক্ষা করা কঠিন।’