বিচারে ধীরগতিতে ক্ষোভ

২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বাইতুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাসের লাইনের ছিদ্র থেকে বিস্ফোরণে

৩৪ জনের মৃত্যু হয়।

স্বামীর সঙ্গে কাটানো সময়গুলো এখন কেবলই স্মৃতিময় ছবি। অগ্নিকাণ্ডে নিহত ঈমান হোসেন ইমরানের স্ত্রী মুক্তা আক্তার। নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা এলাকায়
ছবি: দিনার মাহমুদ

দুই বছর আগে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লায় মসজিদে গ্যাসের লাইনের ছিদ্র থেকে বিস্ফোরণে দুই ছেলে মো. সাব্বির ও মো. জোবায়েরকে হারান পারুল বিবি। সাব্বির স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন, আর জোবায়ের নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। দুই ভাই টিউশনি করে সংসার চালাতেন। তাঁদের হারিয়ে নিঃস্ব পারুল বিবি। এ ঘটনায় এখনো বিচার না হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

পারুল বিবি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামী নেই। মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে পড়া ছোট ১১ বছরের শিশু ইয়াসিনকে নিয়ে অনেক কষ্টে বেঁচে আছি। এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন মানুষের বাড়িতে গিয়ে আরবি পড়িয়ে সংসার চালাই। ছেলে দুটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নগুলোও মরে গেছে আমার। দুই বছরেও দায়ীদের বিচার হয়নি। এতগুলো মানুষ যাদের কারণে মারা গেল, তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।’

২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এশার নামাজের পর শহরের পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাসের লাইনে ছিদ্রের কারণে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। দগ্ধদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন তিনজন। আজ রোববার ওই ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ ঘটনায় এখনো বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন নিহতদের স্বজনেরা।

ওই বিস্ফোরণে মারা যান প্রিন্টিং কারখানার কর্মচারী হুমায়ুন কবীর। তাঁর আয় দিয়ে প্রতিবন্ধী এক সন্তানসহ ছয়জনের সংসার চলত। হুমায়ুনের মৃত্যুতে তাঁর স্ত্রী মমতাজ বেগমের কষ্টের শেষ নেই। তিনি বলেন, স্বামী থাকতে তাঁদের সংসারে কোনো অভাব ছিল না। এখন সন্তানদের নিয়ে একেকটি দিন তাঁর অভাব–অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। িবচারের দাবি জানিয়ে মমতাজ আঁচল দিয়ে ঢেকে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করছিলেন।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি, তিতাস গ্যাস, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ (ডিপিডিসি) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা–কর্মচারীসহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে ফতুল্লায় মডেল থানায় মামলা করে। তদন্তে বলা হয়, সড়কের মাটি খুঁড়ে তিতাস গ্যাসের পরিত্যক্ত সরকারি তিনটি রাইজারের পাইপলাইনে ৯টি ছিদ্র ছিল। ছিদ্র দিয়ে মাটি ভেদ করে গ্যাস মসজিদের ভেতরে জমা হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে।

মসজিদে বিস্ফোরণের পর তিতাস গ্যাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর, তিতাস গ্যাসের ৮ জন কর্মকর্তা–কর্মচারী ও ডিপিডিসির ২ জন মিটার রিডারসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে পুনরায় চাকরিতে বহাল করা হয়। বর্তমানে সবাই জামিনে আছেন।

এ মামলায় মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুরসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। সাক্ষ্য প্রমাণে তিতাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাসলাইনের ছিদ্র মেরামত ও সঠিকভাবে তদারকি না করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ লাইন স্থানান্তর না করার প্রমাণ পায় সিআইডি। কিন্তু তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ থেকে অনাপত্তিপত্র না পাওয়ায় তখন তাঁদের অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

তবে নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিতাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে করা অভিযোগ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আমলে নিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়েছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ। ফলে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

তল্লা এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, মসজিদে তিতাস গ্যাসের কোনো সংযোগ ছিল না। তিতাস গ্যাসের লিকেজ থেকে মসজিদে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা–কর্মচারীসহ এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।