মামলায় বিপর্যস্ত বিএনপি এখন হাজিরার চক্করে

গত ২৮ অক্টোবরের পর গ্রেপ্তার বিএনপির নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের পর জামিনে মুক্ত হচ্ছেন।

ময়মনসিংহ জেলার মানচিত্র

ময়মনসিংহ উত্তর জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন। গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘাতের পর তাঁর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। একটি নিজ এলাকা নান্দাইলে, অন্যটি ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায়। একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২৫ দিন জেল খেটেছেন তিনি। মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত মোফাজ্জলের পরিবার অর্থসংকটের কারণে তাঁর জামিনের ব্যবস্থা করতে পারেনি। পরে স্থানীয় এক নেতার সহযোগিতায় জামিনে মুক্তি পান। এখন প্রতি মাসে অন্তত দুবার তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা বিএনপির কর্মী বিল্লাল হোসেন নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হন গত বছরের ২৯ অক্টোবর। আত্মীয়স্বজন না থাকায় এবং বিএনপির অধিকাংশ দায়িত্বশীল নেতা আত্মগোপনে থাকায় তাঁর পক্ষে কেউ জামিনের আবেদন করেননি, খোঁজও নেননি। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির সহযোগিতায় তিনি জামিনে মুক্তি পান। এখন প্রতি মাসে তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।

এখনো কয়েকটি মামলায় বিএনপির নেতা–কর্মীরা কারাগারে আছেন। তাঁদের পরিবারের অর্থকষ্ট বর্ণনাতীত।
এম কে মুরাদুজ্জামান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শেরপুর জেলা বিএনপি

মোফাজ্জল ও বিল্লালের মতো বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গত ২৮ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসে ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জেলায় অন্তত ৬০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহে ৩০টি, শেরপুর ও নেত্রকোনায় ১২টি করে এবং জামালপুরে ৬টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলার এজাহারনামীয় আসামি তিন হাজারের বেশি। চার জেলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন আট শতাধিক নেতা-কর্মী। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বেশির ভাগই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে অর্থসংকটসহ নানা কারণে নেতা-কর্মীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

শেরপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. হযরত আলী বলেন, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ বানচালের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় ন্যক্কারজনকভাবে হামলা করে সরকার। এর প্রতিবাদে পরদিন সারা দেশে হরতাল দেয় বিএনপি। ওই কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশে একের পর এক মামলা দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করে।

বেশি মামলা ময়মনসিংহে

গত সাড়ে তিন মাসে ময়মনসিংহের ১৩টি থানায় অন্তত ৩০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির আওতাধীন ৬ থানায় ২২টি মামলা হয়েছে। বাকি আটটি দক্ষিণ ও মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা হয়। এসব মামলার এজাহারনামীয় আসামি প্রায় দেড় হাজার। এর মধ্যে কয়েক শ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন। কেউ কেউ একটি মামলায় জামিনে মুক্তির পর আবার গ্রেপ্তার হয়েছেন।

ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার বলেন, উত্তরের সাতটি উপজেলায় ২২টি মামলা হয়েছে। ফুলপুর ও তারাকান্দার ছয়টি মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের আতঙ্কে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়েছে। পুলিশি হয়রানিতে নেতা-কর্মীরা রাতে বাড়িতে থাকতে পারেন না।

নেত্রকোনা বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নেত্রকোনায় ১২টি মামলায় বিএনপির ৭১২ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি ৮৯৫ জন। গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৭১ জন। এর মধ্যে ৬ জন ছাড়া বাকি সবাই কারামুক্ত হয়েছেন। জেলার ১০টি থানার মধ্যে কেন্দুয়ায় সবচেয়ে বেশি ৫টি মামলা হয়েছে।

বারহাট্টা উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, ২০১৫ সালে তাঁর নামে চারটি মামলা হয়। এরপর কোনো মামলা না হলেও গ্রেপ্তারের আতঙ্কে ২৮ অক্টোবর থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একেকটি রাত কাটিয়েছেন। কোনো আত্মীয় মারা গেলেও দেখতে যেতে পারেননি। ৭ জানুয়ারি ভোটের পর পুলিশি হয়রানি একটু কমেছে। তবে বিভিন্ন মামলার হাজিরা দিতে হচ্ছে।

দলীয় সূত্র জানায়, শেরপুরের পাঁচ উপজেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা হয়েছে। সদর ও শ্রীবরদীতে ৪টি করে, নালিতাবাড়ী ও নকলায় ১টি করে এবং ঝিনাইগাতীতে দুটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সদরে ৭৭, শ্রীবরদীতে ৭১, নালিতাবাড়ীতে ২৮, নকলায় ৩১ ও ঝিনাইগাতীতে ৩৩ জন গ্রেপ্তার হন। আটজন ছাড়া সবাই নির্বাচনের পর কারামুক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে জামালপুরে চার থানায় ছয়টি মামলা হয়েছে। সদর ও সরিষাবাড়ীতে দুটি করে এবং দেওয়ানগঞ্জ ও মেলান্দহে একটি করে মামলা হয়েছে। জামালপুর শহর বিএনপির সভাপতি লিয়াকত আলীসহ অন্তত ৫০ জন এখনো কারাগারে আছেন।

আদালতে বিড়ম্বনা, অর্থকষ্ট

সম্প্রতি ময়মনসিংহের আদালতপাড়ায় গিয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা বিএনপির সমর্থক আইনজীবী আবু জাফর মো. রাশেদের চেম্বারের সামনে ভিড় করছিলেন। সেখানেই কথা হয় উত্তর জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিভিন্ন মামলায় পড়ে ব্যবসার ক্ষতি হতে হতে এখন তিনি বিপর্যস্ত।

শেরপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম কে মুরাদুজ্জামান বলেন, এখনো কয়েকটি মামলায় বিএনপির নেতা–কর্মীরা কারাগারে আছেন। তাঁদের পরিবারের অর্থকষ্ট বর্ণনাতীত।

জামালপুর জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক মো. ইমরান হোসেন ৩৬ দিন কারাগারে থেকে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন। তিনি বলেন, যে মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়, ওই ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না।