নিষিদ্ধ ঘন চিনি আমদানি, চলে ‘গোপনে’ বিক্রি
আমদানি নিষিদ্ধ হলেও চট্টগ্রামের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ঘন চিনি বা সোডিয়াম সাইক্লামেট। তবে প্রকাশ্যে নয়, ‘গোপনে’ কেবল পরিচিত ব্যক্তিরা গেলেই এই পণ্য বিক্রি করা হয় বলে জানা গেছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে এসব ঘন চিনি। গতকাল বুধবারও চট্টগ্রাম বন্দরে চার টনের বেশি ঘন চিনি আটকের খবর জানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই পণ্য চিনির বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ চিনির চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি কৃত্রিম মিষ্টিকারক ঘন চিনি। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, আইসক্রিম, জুস, চকলেট, কনডেন্সড মিল্ক ও শিশুখাদ্য তৈরিতে সাধারণ চিনির পরিবর্তে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই ক্ষতিকারক কৃত্রিম উপাদানটি ব্যবহার করে থাকেন। ঘন চিনির দ্বারা প্রস্তুত খাদ্য ক্যানসারসহ কিডনি ও লিভারের জটিল রোগের কারণ হতে পারে।
দেশে ঘন চিনির ব্যবহার বহুদিন ধরেই চলছে। তবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হলেও বাজারে এটি বন্ধে তদারকই তেমন হয়নি। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, ব্যবহৃত হলেও অভিযানে গিয়ে ঘন চিনি পান না তাঁরা। আড়াই বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের সাগরিকা এলাকায় একটি আইসক্রিম কারখানা সিলগালা করা হয়। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘন চিনি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত ৩ মাসে ৩টি চালানে প্রায় ১০৪ টন ঘন চিনি আটক করেছে কাস্টমস।
দেশে ঘন চিনির ব্যবহার বহুদিন ধরে চলছে। তবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হলেও বাজারে এটি বন্ধে তদারকই তেমন হয়নি। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, ব্যবহৃত হলেও অভিযানে গিয়ে ঘন চিনি পান না তাঁরা।
এর বাইরেও কিছু ঘন চিনি বাজারে আসছে বলে অভিযোগ আছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ পেয়েছি। অভিযানও চালানো হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কারখানায় গিয়ে ঘন চিনি পাওয়া যায়নি।’
বিক্রি হয় স্যাকারিন নামে
চট্টগ্রামে ঘন চিনি স্থানীয় বাজারে পরিচিত স্যাকারিন বা স্যাকারাইন হিসেবে। তবে ঘন চিনি ও স্যাকারিনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। স্যাকারিন মূলত কৃত্রিম চিনি। একসময় দেশে খাদ্যপণ্যের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে প্রকাশ্যেই স্যাকারিন বিক্রি হতো। দুই বছর আগে অভিযানের পর বাজারে এর বেচাকেনা কমে যায়। তবে বন্ধ হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মূলত ঘন চিনিকেই স্যাকারিন হিসেবে এখানে বিক্রি করা হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘন চিনি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত তিন মাসে তিনটি চালানে প্রায় ১০৪ টন ঘন চিনি আটক করেছে কাস্টমস। এর বাইরেও কিছু ঘন চিনি বাজারে আসছে বলে অভিযোগ আছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও আছদগঞ্জের ৩০টি মসলার দোকানে স্যাকারিনের খোঁজ করা হয়। তবে সব দোকানিই জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে এ পণ্য নেই। তবে অন্তত পাঁচজন দোকানি এর বেচাকেনার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন। দাম প্রতি ১০০ গ্রাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বলে জানিয়েছেন তাঁরা। অনলাইনেও ফুডগ্রেড স্যাকারিন ৫০ গ্রাম ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
স্যাকারিন অতিমাত্রায় দীর্ঘদিন সেবন করলে কিডনিতে সমস্যা হতে পারে
স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্যে খাতুনগঞ্জের অন্যতম পুরোনো একটি দোকানে স্যাকারিনের খোঁজ করলে তাঁরা অস্বীকার করেন। তাঁরা জানান, তাঁদের আশাপাশের দোকানে বিক্রি হয়। নাম প্রকাশ না করে দুই ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানান, মসলার দোকানে এখনো বিক্রি হয়। তবে গেলেই পাওয়া যাবে না। পরিচিত ব্যতীত কারও সামনে এসব পণ্যের কথা স্বীকার করেন না তাঁরা। সম্প্রতি কাস্টমসের জব্দ করার খবরে সবাই সতর্ক। তাই সবাই অস্বীকার করছেন।
বেশি মাত্রায় দুটোই ক্ষতিকর
ঘন চিনি ও স্যাকারিনের বিষয়ে চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য–গবেষক, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, ঘন চিনি পুরোপুরি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, অন্যদিকে স্যাকারিনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত সেবন করা যায়। তবে মাত্রা ছাড়ালে কিডনির সমস্যা হতে পারে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, স্যাকারিন অতিমাত্রায় দীর্ঘদিন সেবন করলে কিডনিতে সমস্যা হতে পারে। অন্যদিকে বিএসটিআই চট্টগ্রামের উপপরিচালক (সিএম) মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে সোডিয়াম সাইক্লামেট বা ঘন চিনি নিষিদ্ধ।
নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তারা জানান, কিছু গবেষণায় সোডিয়াম সাইক্লামেট ক্যানসার, ক্রোমোজোম পরিবর্তন, হাড়ের কোষের ক্ষতি, প্রজনন সমস্যা ও দীর্ঘ মেয়াদে পাচনতন্ত্রের অসুবিধার ইঙ্গিত দিয়েছে। অন্যদিকে স্যাকারিন খুব বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি, ক্রোনিক রোগের প্রবণতা, স্থূলতা বৃদ্ধি এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে কিডনির ওপর চাপ পড়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারহান ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীতকালে আইসক্রিম কারখানায় উৎপাদন কম হয়। তাই শীতে ঘন চিনির ব্যবহার কম। তবে মিষ্টির কারখানা থেকে বিএসটিআইসহ আমরাও নমুনা সংগ্রহ করতে পারি। কারণ, শিরায় মেশালে চিনি, ঘন চিনি আর স্যাকারিন খালি চোখে আলাদা করে বোঝার উপায় নেই।’