শত বছরের পুরোনো চট্টগ্রামের ‘১৯৩৭ সাবান’

কারখানায় সাবান মোড়কজাত করছেন এক শ্রমিক। সম্প্রতি চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকায় ১৯৩৭ সাবান কারখানায়ছবি: সৌরভ দাশ

বিশালাকার কড়াইতে একসঙ্গে মেশানো হয় কাঁচামাল। সেখানে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা গরম করার পর আনা হয় পাশে ছোট কড়াইতে। কিছুটা ঠান্ডা হওয়ার পর নির্দিষ্ট আকারের দুটি অর্ধগোলাকার ছাঁচে নেওয়া হয় সাবানের মণ্ড। এরপর দুই পাশ জোড়া দিয়ে রাখার হয় জমাট বাঁধার জন্য। তারপর কারিগরেরা গোলাকার চামচের সাহায্যে প্রস্তুত করেন চট্টগ্রামের শত বছরের পুরোনো গোলাকার সাবান, যা পরিচিত ‘১৯৩৭ সাবান’, ‘গোল্লা সাবান’ ও ‘বাংলা সাবান’ নামে।

ব্রিটিশ আমল থেকে চট্টগ্রাম নগরের চাক্তাই খাল এলাকায় প্রস্তুত হচ্ছে এই সাবান। ১৯১৯ সালে চাক্তাই এলাকায় এই কারখানা গড়ে তোলেন নূর আলী সওদাগর। ভারতের টাটা কোম্পানির সিআই শিট বিক্রির এজেন্সি ছিল তাঁর। কারখানা চালুর পর ১৯৩৭ সালে নিবন্ধন নেওয়া হয় কারখানার। নিবন্ধন নেওয়ার বছরকে ব্র্যান্ড হিসেবে বেছে নিয়ে ‘১৯৩৭ সাবান’ হিসেবে নামকরণ করা হয় দেশীয় এই সাবানের। বর্তমানে নূর আলী সওদাগরের তৃতীয় প্রজন্ম নূর আলী সওদাগর অ্যান্ড সন্স নামে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

বাজারে এখন চালু থাকা বাংলা সাবানের সবচেয়ে পুরোনো ব্র্যান্ড চট্টগ্রামের ‘১৯৩৭ সাবান’। সুগন্ধি সাবানের প্রচলন শুরুর আগে এই কাপড় কাচা সাবান বা গোসলের সাবান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চট্টগ্রামের লোকজনের কাছে এই নামটি খুব চেনা। এতই যে বাংলা সাবানের নামটি হয়ে ওঠে ‘সাঁইত্রিশ সাবানের গোল্লা’ হিসেবে। এই সাবান বিক্রির জন্য একসময় মুদিদোকানগুলোয় জিআই তার বেঁধে রাখা হতো। প্রয়োজনমতো এক গোল্লা সাবান তার দিয়ে কেটে খুচরা ক্রেতাদের দেওয়া হতো।

শুরু থেকে চট্টগ্রামের মানুষজনের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এ সাবান। বর্তমানে চট্টগ্রামের সব উপজেলার পাশাপাশি কক্সবাজার, টেকনাফ, চকরিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে এটি জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৩৭–এর আগে পরে নানা সংখ্যা বসিয়ে বা বাদ দিয়ে চট্টগ্রামে অনেকগুলোর ব্র্যান্ডের সাবান বাজারজাত হয়ে আসছে। কেউ-বা হুবহু একই নামে বাজারজাতও করেছে। এ নিয়ে একবার মামলাও হয়েছে। পরে উদ্যোক্তারা এসবে আর মাথা ঘামাতে চাননি।

১০৫ বছর পেরিয়ে ‘গোল্লা সাবান’

ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামে সবচেয়ে প্রাচীন কারখানা হিসেবে ১৯৩৭ সাবানের কথাই বেশি আলোচনা হয়। তবে বাংলাদেশ অঞ্চলে সাবানের সবচেয়ে প্রাচীন কারখানাটি ছিল ঢাকায়। ঢাকা চেম্বার থেকে প্রকাশিত ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বই থেকে জানা যায়, ১৯০৩ সালে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরি কারখানাটি সবচেয়ে প্রাচীন। ১৯৪০ এর দশকে ঢাকায় অন্তত ১০০টি কারখানা গড়ে ওঠে। চট্টগ্রামে চাক্তাই, মাদারবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় কাপড় কাচার সাবানের কারখানা রয়েছে এখনো।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার (তৎকালীন লিভার ব্রাদার্স) ১৯৬৪ সালে সাবান কারখানা গড়ে তোলার আগে নুর আলী সওদাগর সাবানকে পরিচিত করেছেন চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে। চট্টগ্রামের প্রাচীন এই কারখানা কীভাবে গড়ে তোলা হলো তা তৃতীয় প্রজন্মের কাছে অজানা। তবে ধারণা করা যায়, ব্যবসার সুবাদে ভারতের টাটা কোম্পানির সাবানের কারখানা দেখে নুর আলী সওদাগর চট্টগ্রামে এই কারখানা গড়ে তোলেন।

কারখানায় সবান প্রস্তুত করছেন এক শ্রমিক। সম্প্রতি চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকায় ১৯৩৭ সাবান কারখানায়
ছবি: সৌরভ দাশ

কারখানার শত বছরের পথচলার গল্প শুনিয়ে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিক আহমদ জানান, সনাতন পদ্ধতিতে সাবান তৈরি হলেও মানে ও ওজনে কখনো আপস করেননি তাঁর দাদা নুর আলী সওদাগর। তৃতীয় প্রজন্মে এসেও তারাও সেই ধারা বজায় রেখেছেন। ওজন কমে যাতে সমস্যা না হয় সে জন্য প্রতিটি সাবানে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি দেওয়া হয়।

কারখানার আরেক পরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আমাদের মূল বাজার হলো গ্রামে। শহরের মানুষের জন্য মেশিনের মাধ্যমে বার তৈরির পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া পাউডার (ওয়াশিং পাউডার) উৎপাদনের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। এখন চতুর্থ প্রজন্ম এসে গেছে। তাঁরা আধুনিকভাবেই চিন্তা করছে সবকিছু। আধুনিকতায় ঐতিহ্য হারাবে না কারণ কাঁচামাল একই থাকবে।

সাবান তৈরিতে ‘এক জীবন’ পার

গত মঙ্গলবার চাক্তাই এলাকায় প্রাচীন এই কারখানায় দেখা যায়, এক সারিতে চারটি বড় কড়াই। এর দুটিতে কাঁচামাল মিশিয়ে রাতভর ফুটিয়ে রাখা নরম সাবান। ফুটানো কাঁচামালের এই মন্ড লোহার বালতি দিয়ে নিয়ে আরেকটি ছোট কড়াইয়ে রাখছেন শ্রমিকেরা। জমাট বাঁধার জন্য তাতে সোডিয়াম সিলিটেক ও বিভিন্ন ধরনের তেল মেশানো হচ্ছে।

এরপর শ্রমিকদের আরেক দল অর্ধগোলাকার ছাঁচে রেখে তা বৈদ্যুতিক পাখায় শুকিয়ে নিচ্ছেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নানা ধাপ পেরিয়ে তৈরি হয় আধা কেজি ওজনের গোল্লা সাবান। বর্তমানে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ মণ বা আড়াই হাজার কেজি সাবান তৈরি হয় এখানে। শত বছর ধরে একই ছাঁচে তৈরি হচ্ছে গোলাকার সাবান। পাশাপাশি ১৩০ গ্রাম ওজনের সাবানও বাজারজাত করা হচ্ছে। মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন সাবান উৎপাদন চলে এখানে।

কারখানায় সবান প্রস্তুত করছেন এক শ্রমিক। সম্প্রতি চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকায় ১৯৩৭ সাবান কারখানায়
ছবি: সৌরভ দাশ

কারখানায় শ্রমিক রয়েছেন ৫০ জনের মতো। সবাই চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন এখানে। তবে অধিকাংশ শ্রমিকই এখানে কাজ করছেন ২০ থেকে ৩০ বছরের বেশি। কাজের ফাঁকে কথা হয় কারখানাশ্রমিক মোহাম্মদ নাজিরের সঙ্গে। ৫৩ বছর বয়সী নাজির জীবনের ৩৩ বছর কাটিয়েছেন এই কারখানাতেই। জানতে চাইলে মোহাম্মদ নাজির বলেন, ‘এখানেই এক জীবন পার করে দিয়েছি।’

বর্তমানে প্রতি গোল্লা সাবানের খুচরা মূল্য ৮০ টাকা। তবে একসময় তা ৭৫ টাকা ছিল। কারখানার কর্মচারীরা জানান, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে ১৩০ গ্রাম ওজনের গোলাকার সাবানটির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা। যেটি আগে ২২ টাকা ছিল। তবে তাঁর ৩ থেকে ৫ টাকা বাড়লেও ‘১৯৩৭ সাবানের’ চাহিদা কমেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় কারখানার সামনে প্রতিদিন সকাল থেকে সাবান কিনতে মানুষের সারি দেখে।