আমরা আম্মার শেষ ইচ্ছাটাই পূরণ করেছি: ফরিদা পারভীনের ছেলে নাহিল

কুষ্টিয়া পৌর গোরস্তানে ফরিদা পারভীনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ রোববার রাতেছবি: প্রথম আলো

‘আম্মা যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন তাঁর শেষ ইচ্ছাটা ছিল কুষ্টিয়াতে একবার আসতে চান। এবং ওনার (আম্মা) শেষ ইচ্ছাটা ছিল তাঁর মা–বাবার কবরে তাঁকে শায়িত করা হোক। আমরা ওনার শেষ ইচ্ছাটাই পূরণ করছি।’

লালনসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের জানাজার আগে এসব কথা জানালেন তাঁর ছেলে ইমাম নাহিল। জানাজা শেষে রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে কুষ্টিয়া পৌর গোরস্তানে মা–বাবার কবরে চিরশায়িত করা হয় ফরিদা পারভীনকে। এ সময় সেখানে তাঁর দুই ছেলে ইমাম নাহিল, ইমাম নিমেরী, এক মেয়ে জিহান ফারিয়াসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

গতকাল শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন (৭১)। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। রাত ৮টা ২৩ মিনিটে ফরিদা পারভীনের মরদেহ বহনকারী ফ্রিজিং গাড়ি ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া পৌর গোরস্তানে এসে পৌঁছায়।

সেখানে অনুষ্ঠিত জানাজায় লালন একাডেমির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন, চিন্তক ও কবি ফরহাদ মজহার অংশ নেন। ফরিদা পারভীনের জানাজা পড়ান কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোল্লা মো. রুহুল আমীন।

আরও পড়ুন

জানাজার আগে ফরিদা পারভীনের ছেলে ইমাম নাহিল তাঁর মায়ের জন্য দোয়া চেয়ে বলেন, ‘কুষ্টিয়াতেই আমার আম্মার বেড়ে ওঠা। এখানে থেকেই তাঁর জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন। তাঁর কোনো অন্যায় যদি হয়ে থাকে, সন্তান হিসেবে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কুষ্টিয়ার কথা আম্মা সব সময় বলতেন।’

ফরিদা পারভীনের লাশ কুষ্টিয়া পৌর গোরস্তানে নেওয়ার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আজ রোববার রাতে
ছবি: প্রথম আলো

ফরহাদ মজহার বলেন, ‘কুষ্টিয়া হলো নদীয়া। এই নদীয়ার ভাবের কথা ফকির লালন জানে কি তা। বিশাল ভাবের জগৎ। সেই বিশাল ভাবের জগৎটা একেবারে অন্ধকারের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল। ফরিদা পারভীনের মাধ্যমে এটা সামনে এসেছে। ফরিদার গানের যে মাধুর্য, তার গলার যে মাধুর্য, তার যে বিশেষভাবে পরিবেশনার ভঙ্গি, সাধু জগতে অত্যন্ত পরিচিত। এখানকার যে ভাবসংগীত, সেটার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সেই দীর্ঘ ইতিহাসের যে সুতাটা ছিঁড়ে গিয়েছিল, সেই সুতাটা ফরিদা পারভীন বেঁধে দিয়েছেন।’

জানাজা শেষে জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্য আজকের সংগীতাঙ্গনে একটা শোকের ছায়া। তাঁকে শত শত বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ মনে রাখবে। আমরা শোকাহত। বাংলাদেশে সংগীতাঙ্গনে তাঁর যে অবদান, তা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তিনি একজন গুনী মানুষ ছিলেন। কুষ্টিয়াবাসীর অন্তরে দীর্ঘদিন থাকবেন।’

১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে তাঁকে। শৈশবে যখন মাগুরায় ছিলেন, তখন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয়। ১৯৫৭-৫৮ সালে চার-পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। এরপর যেখানেই থেকেছেন, সেখানেই বিভিন্নজনের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন তিনি। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী নির্বাচিত হন।

ফরিদা পারভীন
ছবি: খালেদ সরকার

স্বাধীনতার পর লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদা পারভীনের যোগাযোগ, তখন তিনি কুষ্টিয়ায় থাকতেন। সেখানে তাঁদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তাঁর কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শেখার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনগীতির তালিম নেন। লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বদরবারেও তিনি লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরকে প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

লালনগীতিতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। এর বাইরে ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (নারী) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন।