প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কেন কমছে না ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হচ্ছেন বলে অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়া, ভিন্ন মতের হলেই নির্যাতন কিংবা নতুন শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিং করা, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মূলত দুই বছর ধরে কমিটি না থাকার কারণেই ছাত্রলীগ লাগামহীন হয়ে পড়েছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই থামছে না বলে একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলেন, ছোট-বড় বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্রদের তিনটি হলেই ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হেনস্তা করছেন। মতের সামান্য ভিন্নতা হলেই হল থেকে মারধর করে শিক্ষার্থীদের তাঁরা বের করে দিচ্ছেন।

তিনটি আবাসিক হলের একাধিক শিক্ষার্থী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দীর্ঘদিন ধরে কমিটি নেই। বর্তমানে এখানে ছাত্রলীগের ছয়টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্রুপ নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতেই হলে প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কবজায় রাখার চেষ্টা চালায়। ফলে সামান্য ভিন্ন মতের হলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারধরের শিকার হয়েও ভয়ে কোনো অভিযোগ করেন না। এ ছাড়া হলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ছয়টি গ্রুপ প্রায়ই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়ায়।

সবশেষ গত শুক্রবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগের নেতা মো. রিশাদ ঠাকুর তাঁর কক্ষে ডেকে এনে সংগঠনের কর্মী নূর মোহাম্মদ বায়েজিদকে বেধড়ক মারধর করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গত রোববার অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আজীবনের জন্য অবাঞ্ছিত করেছে।

এর আগে গত বুধবার মধ্যরাতে মেহেদী হাসান ও সৈকত রায় নামের দুই আবাসিক ছাত্রকে গালিগালাজ ও মারধর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ৪২০ নম্বর কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের ইংরেজি বিভাগ শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ওরফে সীমান্ত ও তাঁর অনুসারীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। যদিও এ অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন অভিযুক্ত আজিজুল ইসলাম।

হলের একাধিক আবাসিক শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর হলগুলোয় একাধিক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলে গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদ চৌধুরী এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. দেলোয়ার হোসেনকে মারধর করে বের করে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া গত সাড়ে সাত মাসে হলের আসন দখল ও আধিপত্য বজায় রাখা নিয়ে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে ছোট-বড় অন্তত সাতবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে জড়ায়।

এর বাইরে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ১১১ নম্বর কক্ষে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ১০ শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী র‍্যাগ দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় গত ২২ মার্চ ১৬ শিক্ষার্থীকে সব হল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তবে তাঁদের দলীয় পদ নেই। এই পাঁচজন হলেন—মো. আপন মিয়া, মো. আল আমিন, মো. পাবন মিয়া, মো. রিয়াজ হোসেন ও মো. আশিক হোসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুজন সাবেক নেতা বলেছেন, মূলত দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি না থাকার কারণে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা লাগামহীন হয়ে পড়েছেন। কেউ কারও কথা মানছেন না। মূলত নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই ছয়টি পৃথক গ্রুপ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি গ্রুপই আলাদাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। এতে বছরজুড়েই নানা ধরনের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। কমিটি থাকলে নেতা-কর্মীদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকত। নতুন কমিটি গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংকট দূর হবে না।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সবশেষ ২০১৩ সালের ৮ মে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি হয়। পরে ২০১৬ সালের ৮ মে এই কমিটিকে ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রূপ দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ১৭ জুন এ কমিটি বিলুপ্ত হয়। কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর গত দুই বছরে ছাত্রলীগের ৬টি গ্রুপ অন্তত ২০ বার ছোট-বড় সংঘর্ষে জড়িয়েছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি। এর বাইরে মতের ভিন্নতার কারণে কিছুদিন পরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা আছেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় থাকা ছাত্রলীগের ছয়টি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক খলিলুর রহমান, সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক সজীবুর রহমান, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুমন মিয়া, ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হুদা ওরফে শুভ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক সহসভাপতি মামুন শাহ ও ইংরেজি বিভাগ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ওরফে সীমান্ত। এর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খলিলুর রহমান গ্রুপের।

খলিলুর রহমান বলেছেন, এটা ঠিক, কমিটি না থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে চেন অব কমান্ড অনেকটাই নেই। তবে হল থেকে বের করে দেওয়া কিংবা র‍্যাগিংয়ের কোনো ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। মূলত সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে অনেক সময় হলের কক্ষগুলোয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনোমালিন্য বা ঝামেলা হয়। ছাত্রলীগ এমন কোনো ঘটনা জানলে সেখানে গিয়ে সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করে।