ডেঙ্গুতে আগস্টে ছয়জনের মৃত্যু, আক্রান্ত বাড়ছে

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আক্রান্ত ১২ হাজার ২৪৬ জন। শহরের দুই ওয়ার্ড ও উখিয়ার তিন আশ্রয়শিবিরে প্রকোপ বেশি।

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাছবি: রয়টার্স

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডটি সমুদ্র উপকূলীয় ১৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। লোকসংখ্যা প্রায় ৬৩ হাজার। ঘনবসতির এই ওয়ার্ডে দেশের সর্ববৃহৎ নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লির অবস্থান। সম্প্রতি এই পল্লির ঘরে ঘরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল শুক্রবার সকালে এই ওয়ার্ডের সমিতির পাড়া ও কুতুবদিয়াপাড়া থেকে অন্তত ২৩ জনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এই পল্লির অন্তত ৯৭ জনকে। এ ছাড়া গত ৯ আগস্ট মারা যায় এই ওয়ার্ডের আট মাস বয়সী এক শিশু।

একই অবস্থা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী এলাকায়। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট দিবাগত রাত দেড়টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পাহাড়তলীর স্কুলছাত্র তানভীর আহমদের (১৪) মৃত্যু হয়েছে। সে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। আগস্ট মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ছয়জন। এর মধ্যে স্থানীয় এই দুই শিশুকিশোর ছাড়া বাকিরা রোহিঙ্গা।

নাজিরারটেকের সমিতির পাড়ার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রানা (৪০) বলেন, সমুদ্র উপকূলীয় এই শুঁটকিপল্লিতে পাঁচ-ছয়টি নালা ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। রাস্তার পাশে নালাগুলোর একই অবস্থা। শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র হওয়ায় মশা-মাছির উৎপাত লেগে থাকে। ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানের জলাশয়ে জমে থাকা পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে এডিস মশার লার্ভা থাকলেও এগুলো ধ্বংসের উদ্যোগ নেই। যে কারণে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে মোহাম্মদ রানা বলেন, গত ৯ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর আট মাস বয়সী মেয়ে তাসকিয়ার মৃত্যু হয়েছে। তাসকিয়ার প্রথমে জ্বর আসে। চার দিন বাসাতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ভর্তি করা হয় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন তাসকিয়ার মৃত্যু হয়।

পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আক্তার কামাল বলেন, এক মাস ধরে প্রতিটি ঘরে ঘরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাঁর পরিবারের স্ত্রী–সন্তান সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

আক্তার কামাল বলেন, তাঁর এই ওয়ার্ডে ছয়-সাত হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। সময়মতো নালা পরিষ্কার না করা এবং মশকনিধন কার্যক্রম না থাকায় লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।

হাসপাতালে রোগীর চাপ

সর্বশেষ ১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৫২ রোগী। এর মধ্যে ৪৭ জন কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতির পাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া ও পাহাড়তলীর বাসিন্দা। বাকি পাঁচজন রোহিঙ্গা।

গত ৩১ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৪৭ ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে ৪২ জন ওই তিন গ্রামের বাসিন্দা। অন্য পাঁচজন রোহিঙ্গা। ৩০ আগস্ট ভর্তি ছিল ৪০ জন। এর মধ্যে ৩২ জন তিন গ্রামের বাসিন্দা। বাকি আটজন রোহিঙ্গা।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত মাসে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৬৯ ডেঙ্গু রোগী। মারা গেছেন ছয়জন। জুলাই মাসে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৫০ জন। মারা গেছেন ছয়জন। সবাই রোহিঙ্গা। জুন মাসে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৫০ ডেঙ্গু রোগী। মারা গেছেন এক রোহিঙ্গা।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মোমিনুর রহমান বলেন, আগে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া গেলেও এখন স্থানীয় ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলের নাজিরারটেক, সমিতির পাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া ও পাহাড়তলী এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে।

তিন আশ্রয়শিবিরে ডেঙ্গু

উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ২৩টি আশ্রয়শিবিরে কমবেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলেও ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে উখিয়ার তিনটি আশ্রয়শিবির। এগুলো হলো কুতুপালং আশ্রয়শিবির (ক্যাম্প-৩), লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবির (ক্যাম্প-৪) ও কুতুপালং রেজিস্টার্ড আশ্রয়শিবির (ক্যাম্প-১ ওয়েস্ট)। ক্যাম্প-৩ শিবিরে আক্রান্ত ৩ হাজার ৯২২ জন, ক্যাম্প-৪ শিবিরে ৯৫৬ জন ও ক্যাম্প-১ ওয়েস্ট শিবিরে ৭০৭ জন।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ২৪৬। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ১১ হাজার ৬৫৮ জন এবং স্থানীয় ৫৫৮ জন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৪ জন। এর মধ্যে ২২ জন রোহিঙ্গা ও ২ জন স্থানীয়।

কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৩) ডি ১৬ ব্লকের রোহিঙ্গা করিম উল্লাহ বলেন, শিবিরের অভ্যন্তরে পাহাড় থেকে নেমে আসা কয়েকটি ছড়া-খাল দীর্ঘদিন ময়লা-আবর্জনায় ভরে আছে। ময়লার সঙ্গে পানি জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়ে তাঁর চার বছর বয়সী মেয়ে জিসমার মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে করিম উল্লাহ বলেন, জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর মেয়েকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওখানে রক্তবমি করে মেয়ে মারা গেছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা ভূঁইয়া বলেন, তিনটি ক্যাম্পেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আশ্রয়শিবিরের খাল-ছড়ার পাশাপাশি ঘরের আঙিনা পরিষ্কার, জীবাণুনাশক কীটনাশক ছিটিয়ে ডেঙ্গু নির্মূলের
কাজ চলমান।

সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের তিনটি ক্যাম্পকেই ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিবিরগুলোয় ঘনবসতি বেশি। প্রতি ঘরে ৮ থেকে ১০ জন গাদাগাদি করে বাস করছেন। এ কারণে একজনের ডেঙ্গু হলে অন্যদেরও আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। পানিনিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে মশা জন্মানোর সুযোগ বেশি।