‘বৃদ্ধ হওয়ায় অনেকে রিকশায় উঠতে চান না’

৮২ বছর বয়সেও রিকশা চালিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন ফিরোজ তালুকদার
ছবি: প্রথম আলো

ভোরে রিকশা নিয়ে বের হয়ে সন্ধ্যায় ফেরেন বাড়ি। কখনো ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। সারা দিনের আয় এক করে তখন হাতে থাকে বাজার-সদাই। জীবন এভাবেই কাটছে। ৮২ বছরের এই জীবনে কম লড়াই করেননি ফিরোজ তালুকদার (৮২)।

অশীতিপর বৃদ্ধ ফিরোজ তালুকদারের বাড়ি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার নলবুনিয়া গ্রামে। ভূমিহীন হিসেবে উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে তিনি একটি সরকারি ঘর পেয়েছেন। সেখানে স্ত্রী রেকসনা বেগমকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। তাঁদের কোনো সন্তান নেই।

পিরোজপুর শহরের রাজারহাট মহল্লার ডাকবাংলোর সমানে সম্প্রতি এক দুপুরে কথা হয় ফিরোজ তালুকদারের সঙ্গে। জানালেন, সকালে ইন্দুরকানি উপজেলার পাড়েরহাট থেকে যাত্রী নিয়ে পিরোজপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে এসেছেন। এরপর কয়েক জায়গায় ভাড়া নিয়ে গেছেন। এক ব্যক্তিকে শহরের দামোদর সেতু এলাকা থেকে ১৫ টাকা ভাড়ায় রাজারহাট ডাকবাংলোর সামনে নিয়ে এসেছেন। সারা দিন রিকশা চালিয়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন।

ফিরোজ তালুকদার বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘একসময়ে রিকশা চালিয়ে যা আয় করতাম, তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চালাতে পারতাম। এখন সবকিছুর দাম বেশি। শাকসবজি, ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্টের শেষ নেই। প্রতিদিন যা আয় করি, তা দিয়ে রিকশার মালিককে ২০০ টাকা করে দিতে হয়। এরপর ব্যাটারির চার্জ ও গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে যা থাকে, তাতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। রোদে বেশি সময় রিকশা চালাতে পারি না। কোনো দিন ৫০০ টাকা আয় হয়। আবার কখনো ৩০০ টাকাও হয় না। ৫০০ টাকা আয় হলে সব খরচের পর কিছু টাকা হাতে থাকে। আর আয় কম হলে ধারদেনা করতে হয়। এ ছাড়া রিকশা ইজিবাইকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ভাড়াও কম পাওয়া যায়। বৃদ্ধ হওয়ায় অনেকে রিকশায় উঠতে চান না।’

আক্ষেপের সুরে ফিরোজ তালুকদার বলেন, ‘সারা জীবন কষ্ট করেছি। কখনো সুখের মুখ দেখিনি। বাবা সামাদ তালুকদার ছিলেন দরিদ্র মানুষ। অভাবের কারণে তিনি বসতবাড়ি বিক্রি করে দেন। ১৪ বছর বয়সে খুলনা নগরীর খালিশপুরের একটি জুট মিলে চাকরি নিই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আসি। এরপর কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম। ১৯৮৩ সালে রিকশা চালানো শুরু করি। এরপর ৪০ বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছি। তবে রিকশা চালিয়ে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলেও অভাব দূর হয়নি। অসুখের চিকিৎসাও করাতে পারছি না।’

৮২ বছরের জীবনে ফিরোজ তালুকদার অনেক ঘটনার সাক্ষী। তাঁর ইংরেজ শাসনামলের কথা কিছু মনে আছে। তৎকালীন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের শাসনামল দেখেছেন তিনি। ফিরোজ তালুকদার বলেন, ‘আমার মতো ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষের জন্য শেখ হাসিনা অনেক করেছেন। ভাতা দিচ্ছেন, ঘর করে দিয়েছেন। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় আমরা কষ্টে আছি।’