গাজীপুরে শালবনের আগুনে সংকটে জীববৈচিত্র্য 

মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে এসব বন্য প্রাণী ও পাখির অনেকগুলোই বিলীন হয়ে গেছে। গুটিকয় টিকে আছে সংকটাপন্ন অবস্থায়।

বনে বিশাল এলাকাজুড়ে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে অস্তিত্বসংকটে পড়ে সেখানকার জীববৈচিত্র্য। সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুরের গোসিংগা ইউনিয়নের পটকা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রাত আটটা। ঘন শালবনের ভেতর হঠাৎ চোখে পড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে আগুন। কাছে গিয়ে দেখা যায়, বনের শুকনা ডালপালা, পাতা পুড়ছে। আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। এগিয়ে যেতে যেতে একপাল শিয়ালকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখা গেল। বেশ কয়েকটি গুইসাপ ও নিশাচর পাখিও হন্তদন্ত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। এমন দৃশ্য দেখা যায়, ৫ মার্চ ভাওয়াল বনাঞ্চলের গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের পটকা এলাকায়।

বনে অগ্নিকাণ্ডের এমন ঘটনা নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিন শ্রীপুরের বিভিন্ন বনে এমন আগুন লাগার দৃশ্য দেখা যায়। গোসিংগা ইউনিয়নের কর্ণপুর গ্রামের নাঈম জয় জানান, গত রোববার রাত নয়টার দিকে তাঁদের গ্রামের একটি বনে আগুন জ্বলতে দেখেছেন তিনি। বরমী ইউনিয়নের বরামা গ্রামের ইমরান হোসেন জানিয়েছেন, এদিন সন্ধ্যায় তাঁর গ্রামের পাশের পেলাইদ গ্রামের একটি বনে মাঝারি আকারের অগ্নিকাণ্ড দেখেছেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সিমলাপাড়া এলাকায় বনে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এর আগে গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় উপজেলার টেংরা গ্রামে শালবনের ভেতর বিশাল আকারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একই দিন উপজেলার শিরীষগুড়ি এলাকায় বনে আগুন দেখা যায়।

এসব অগ্নিকাণ্ডের উৎস নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, বন ধ্বংস করে বনভূমি দখল করার উদ্দেশ্যেই কিছু দুষ্কৃতকারী অগ্নিসংযোগ করে। কেউ বলেন, বনের পুড়ে যাওয়া পাতা ছাই বানিয়ে পাশের জমিতে ব্যবহারের জন্য এই ঘটনা ঘটানো হয়। কেউ মনে করেন, দুষ্ট লোকেরা অহেতুক বনের শুকনা পাতায় আগুন ধরিয়ে দেন। কারও কারও মতে, এগুলো পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়। রাতে আগুন দেওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত বনের ভেতর থেকে ডালপালা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যেই কেউ কেউ আগুন দেন।

বনে আগুন লাগার পর সেখান থেকে বন্য প্রাণীগুলো জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়। কিছু প্রাণী মারাও যায়। 
নজরুল ইসলাম, স্থানীয় বাসিন্দা 

পটকা গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বনে আগুন লাগার পর সেখান থেকে বন্য প্রাণীগুলো জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়। কিছু প্রাণী মারাও যায়। অগ্নিকাণ্ডের ফলে বনের গাছে থাকা পাখির বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু পাখি ছোট ছোট বাচ্চা রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই আগুনের তীব্রতা শালবনের ভেতরে বিভিন্ন কীটপতঙ্গের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়। অগ্নিকাণ্ডের ফলে শালগাছের ছোট ছোট চারা মারা যায়। এতে নতুন করে শালগাছের জন্ম ব্যাহত হয়।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, কারণ যা–ই হোক, এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে বনের পশুপাখিরা। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুরের শ্রীপুর রেঞ্জের অধীনে শ্রীপুর সদর, শিমলাপাড়া, সিংড়াতলী, সাতখামাইর, কাওরাইদ, গোসিংগা ও রাথুরা বিটের আওতাভুক্ত মোট বনভূমি ২৪ হাজার ২৭১ একর। কমবেশি আগুন দেখা যায় সব এলাকাতেই।

বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, ভাওয়াল বনাঞ্চলে ছিল ১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬ প্রজাতির উভচর, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩৯ প্রজাতির পাখি। বন্য প্রাণীর মধ্যে গন্ধগোকুল, খ্যাঁকশিয়াল, বাগডাশ, খরগোশ, শজারু, বেজি, কচ্ছপ, শূকর, বানর, কাঠবিড়ালি, গুইসাপসহ ছিল নানা প্রাণী। আর এই বনাঞ্চল দেশীয় সব ধরনের পাখির অভয়ারণ্য ছিল। মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে এসব বন্য প্রাণী ও পাখির অনেকগুলোই বিলীন হয়ে গেছে। গুটিকয় টিকে আছে সংকটাপন্ন অবস্থায়। বিভিন্ন কারণের সঙ্গে বনে আগুন দেওয়াও এসব বন্য প্রাণী বিলীন হওয়ার জন্য দায়ী।

বন বিভাগের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, বনে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেলে তারা ফায়ার লাইন কেটে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বিশাল বনের তুলনায় বনকর্মীর সংখ্যা কম হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের বেগ পেতে হয়। অগ্নিকাণ্ডে বনে থাকা পশুপাখির আবাসস্থল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে। তা ছাড়া বনের লতাগুল্ম ও কিছু বিরল উদ্ভিদ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আগুন দিয়ে বন ধ্বংস করে বনভূমি দখল করার জন্য এ কাজগুলো করা হয় বলে মনে করেন শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেব। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বন থেকে পুড়ে যাওয়া ডালপালা সংগ্রহ করতে এবং আগুনের পুড়ে যাওয়া পাতার ছাই জমিতে সার হিসেবে ব্যবহারের জন্যও আগুন দেওয়া হচ্ছে।