পার্বত্য এলাকায় ১১৯টি অবৈধ ইটভাটা
বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নটি পাহাড় বন জঙ্গলে ঘেরা। পাহাড় বা বনের আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন অবৈধ হলেও ইউনিয়নটির তিন বর্গকিলোমিটারের মধ্যে দেখা যায় ৩৬টি চুল্লি। ধোঁয়া উঠছে সব সময়। পুড়ছে বনের কাঠ। ইটভাটার উত্তাপ আর ধুলার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ পার্শ্ববর্তী দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী।
ছোট এলাকার মধ্যে এতগুলো ইটভাটা দেশের আর কোথাও নেই বলছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে শুধু ফাইতং নয়, পুরো পার্বত্য এলাকায় রয়েছে এ রকম ১১৯টি অবৈধ ইটভাটা। বান্দরবানের ৪৪টি ইটভাটার ৩৬টি ফাইতংয়ে। এ ছাড়া রাঙামাটিতে ২৯টি এবং খাগড়াছড়িতে আরও ৪৬টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটায় প্রতিবছর অভিযান চালানো হয়। কিন্তু স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা হয় না। পাহাড়ে যুগ যুগ ধরে এসব ভাটা চলছে।
পাহাড়ের মাটি কেটে ড্রাম চিমনি, সাধারণ মানের চুল্লিতে বনের কাঠ পুড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে নিয়মিত। সব কটি ভাটা অবৈধ হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। আদালতে রিট করে স্থাগিতাদেশ নিয়ে ভাটাগুলো চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ইটভাটার মালিকদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ইসলামীর নেতারাও আছেন।
এখানে কোনো ইটভাটার বৈধতা নেই। ইটভাটার বিরুদ্ধে আমরা অভিযান করি। তারা আদালতের আদেশ দেখিয়ে ভাটার কার্যক্রম চালায়।পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম
তিন পার্বত্য জেলায় এ মৌসুমে অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম যাতে শুরু হতে না পারে, সে বিষয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে পদক্ষেপ নিতে ৫ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল দিয়ে সেখানে থাকা অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ায় এবং কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিল না করায় এইচআরপিবির পক্ষে আবেদনটি করা হয়। আদালতের আদেশের পর যথাযথ উচ্ছেদ অভিযান করা হয় না বলে অভিযোগ এইচআরপিবির।
পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে কোনো ইটভাটার বৈধতা নেই। ইটভাটার বিরুদ্ধে আমরা অভিযান করি। তারা আদালতের আদেশ দেখিয়ে ভাটার কার্যক্রম চালায়।’
লামা সদরের বাজার থেকে গজালিয়া সড়ক ধরে ফাইতংয়ের কাছাকাছি যেতেই দেখা যায় ইটভাটার চুল্লি। সড়কের দুই পাশেই রয়েছে ইটভাটা। ফাইতং বাজারের উত্তর দিকের পাহাড়ি পথ পেরিয়ে শিবাতলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাধিক। স্কুলটির লাগোয়া রয়েছে পাঁচটি ইটভাটা। চেয়ার-টেবিল আর মেঝেতে ভাটার পোড়া ছাই আর ধুলার আস্তরণ দেখা যায়।
শিবাতলী পাড়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিম দিকে রোয়াজাপাড়া। রোয়াজাপাড়া মৈত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেও রয়েছে ইটভাটা। একজন শিক্ষক বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে ইটভাটার যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। ধোঁয়া আর ধুলায় আচ্ছন্ন থাকে পরিবেশ। বাড়িঘরেও একই রকম ধুলা।’
আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর ফাইতং এলাকায় একবার অভিযান চালানো হয়। ২০ জানুয়ারি ৪টি ইটভাটাকে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুপায়ন দেব বলেন, ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।
ফাইতং ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতির সভাপতি মোকতার আহমদ সাবেক ইউপি সদস্য। তিনি ২০০১ সালে চকরিয়ার লক্ষ্যাচর ইউনিয়ন জামায়াতের পদধারী নেতা ছিলেন। সমিতির অধীনে ৪১টি ইটভাটা রয়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে আদালতের আদেশ রয়েছে। তার পরও প্রশাসন এগুলো মানে না। অভিযান চালায়। পাহাড় ও গাছ কাটার জন্য জরিমানা করছে। এখন ১০-১২টি ইটভাটা চলছে।’
ইটভাটার কারণে বায়ু, মাটি দুটোই দূষণের শিকার হয়। পানিরও ক্ষতি হয়। বনের গাছপালা নষ্ট হয়। ‘চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ইটের ভাটা থেকে নিঃসৃত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ নির্ণয়: একটি ভূপরিবেশগত সমীক্ষা’ শিরোনামে একটি গবেষণা থেকে তিন বছর আগে এ তথ্য জানা যায়।
রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে
বান্দরবানের ফাইতংয়ে ইটভাটা রয়েছে ইউনিয়ন বিএনপির প্রচার সম্পাদক নাজেমুল ইসলামের। এ ছাড়া বিএনপির নেতা ফরিদুল আলম, করিমুল মুস্তফা ও ফাইতং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিনের ইটভাটা রয়েছে।
খাগড়াছড়িতে ইটভাটা রয়েছে ৪৬টি। খাগড়াছড়ি ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ সেলিম একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। জেলা পরিষদের সাবেক দুই চেয়ারম্যান কংজুরি চৌধুরী ও মংসুইপ্রু চৌধুরী এবং সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আকতার হোসেনেরও ইটভাটা রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এখন তা বন্ধ রয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ভাটা ছিল দীঘিনালা উপজেলায়। তবে সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনি তা ভাড়া দিয়েছেন বলে জানা গেছে। জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কংজুরি চৌধুরীর বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
রাঙামাটির কাউখালী উপজেলায় ১৬টি, লংগদু উপজেলায় ৬টি, বাঘাইছড়িতে ৩টি, রাজস্থলীতে ৩টি ও কাপ্তাই উপজেলায় ১টি ইটভাটা রয়েছে। একটি ভাটারও বৈধতা নেই। কাউখালীতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বরেরও একটি ভাটা রয়েছে। লংগদুতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন ও ইউপি সদস্য আমিন হোসেনের ইটভাটা রয়েছে।
ইটভাটা স্থাপন অবৈধ
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, কোনো পাহাড় বা টিলার উপরিভাগে, ঢালে বা তৎসংলগ্ন আধা কিলোমিটারের মধ্যে সমতলে ইটভাটা স্থাপন অবৈধ। এ ছাড়া আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে এবং বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।
ইটভাটা পরিচালনায় পরিবেশ ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসন এবং বন বিভাগের অনুমতি লাগে। কিন্তু এসব ভাটার কোনোটাই নেই। দীঘিনালা উপজেলায় ইটভাটার বিরুদ্ধে ২০ জানুয়ারি অভিযান পরিচালনা করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশিদ এতে নেতৃত্ব দেন। এ সময় দুটি ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এখানে ইটভাটা রয়েছে ৬টি।
রিটকারী প্রতিষ্ঠান এইচআরপিবির আইনজীবী মনজিল মোরশেদ প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী পাহাড়ে ইটভাটা স্থাপন দূরে থাক, স্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়ারও সুযোগ নেই। সেখানে অভিযানের নামে জরিমানা করা হচ্ছে। কয় দিন পর এগুলো আবার চালু হবে। এই খেলা তো মানা যায় না।
শুধু বাতাস নয়, ইটভাটা মাটি, পানি ও বনের ক্ষতি করে থাকে। ইটভাটার আশপাশের এলাকার মানুষ চর্ম, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হন।অধ্যাপক অলক পাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক
ইটভাটার দূষণ
ইটভাটার কারণে বায়ু, মাটি দুটোই দূষণের শিকার হয়। পানিরও ক্ষতি হয়। বনের গাছপালা নষ্ট হয়। ‘চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ইটের ভাটা থেকে নিঃসৃত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ নির্ণয়: একটি ভূপরিবেশগত সমীক্ষা’ শিরোনামে একটি গবেষণা থেকে তিন বছর আগে এ তথ্য জানা যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক অলক পালের তত্ত্বাবধানে মোহাম্মদ আলীম উল্লাহ খান নামের একজন এ গবেষণা করেন। গবেষণায় বলা হয়, ৪০ লাখ ইট তৈরিতে একেকটি চুল্লি থেকে প্রায় ৩৯৪ টন কার্বন, ১ হাজার ৪৪৪ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, ৬ দশমিক ৩ টন মিথেন ও ১০২ টন নাইট্রিক অক্সাইড নিঃসৃত হয়।
অধ্যাপক অলক পাল বলেন, শুধু বাতাস নয়, ইটভাটা মাটি, পানি ও বনের ক্ষতি করে থাকে। ইটভাটার আশপাশের এলাকার মানুষ চর্ম, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হন।