প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

গত মঙ্গলবার তিন দফা সড়ক অবরোধ করে বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বিকেলে বিদ্যালয়ের ফটকে
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ের সহপাঠীর মাকে প্রকাশ্যে মাফ চাইতে বাধ্য করার অভিযোগে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-৩ রুবাইয়া ইয়াসমিনকে বগুড়া থেকে প্রত্যাহারে খুশি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তবে এ ঘটনার চার দিনেও বদলিসহ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তারা।

এ ঘটনায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের অন্তত ২০ জন এবং তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার ও আজ শুক্রবার কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, প্রধান শিক্ষক ও শ্রেণিশিক্ষকের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না, সেটা দেখতে তাঁরা কয়েকটা দিন অপেক্ষা করবেন। এরপর আবার আন্দোলনে নামবেন। এ আন্দোলনে বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠনও পাশে থাকবে বলে তাঁদের আশ্বস্ত করেছে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষকদের নির্দেশে প্রতিদিন পালা করে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেয় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বগুড়া জেলা জজ আদালতের ওই বিচারকের মেয়ে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেবে না বলে জানায়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আপত্তি তোলে। এটা নিয়ে ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি পোস্ট দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

ওই বিচারক গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিদ্যালয়ে এসে চার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে মামলা করার হুমকি দেন। এর একপর্যায়ে এক নারী অভিভাবককে মাফ চাইতে বাধ্য করেন তিনি। এ সময় বিচারকের পক্ষ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের টিসি দিয়ে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন ও গালমন্দ করেন প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন। এ ছাড়া প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিনা নোটিশে ডেকে এনে অপমান করেন একজন শ্রেণিশিক্ষক।

প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঘটা এ ঘটনায় ওই দিন বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তিন দফা বগুড়া শহরের সার্কিট হাউসের সামনের সড়ক অবরোধ করে। এর মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নিলুফা ইয়াসমিন শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে শিক্ষার্থীরা দাবি তোলে, ওই বিচারককে বিদ্যালয়ে এসে ভুক্তভোগী অভিভাবকের কাছে মাফ চাইতে হবে। এ ছাড়া প্রধান শিক্ষক ও শ্রেণিশিক্ষককে বদলির দাবি জানায় তারা। একপর্যায়ে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম রাত আটটার দিকে বিদ্যালয়ে গিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের মৌখিক ঘোষণা দেন। এরপর রাত সাড়ে নয়টায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করে।

এরপর বৃহস্পতিবার ওই বিচারককে বগুড়া থেকে প্রত্যাহার করে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচারক) মো. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রাদেশ জারি করা হয়।
এদিকে এ ঘটনায় শুক্রবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিলুফা ইয়াসমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজা পারভীন এবং বগুড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হযরত আলী।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত বিচারককে ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক ও শ্রেণিশিক্ষকের গাফিলাতি খতিয়ে দেখতে বগুড়ার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

১৬ বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে

সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে একই কর্মস্থলে টানা সর্বোচ্চ চার বছর থাকার বিধান রয়েছে বলে জানিয়েছেন বগুড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হযরত আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এক যুগের বেশি সময় ধরে একই প্রতিষ্ঠানে আছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাবেয়া খাতুন ২০০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষকের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব নেন। টানা ১৬ বছরের বেশি সময় একই পদে আছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পাশেই  বগুড়া জিলা স্কুল। সেখানে এই সময়ে ছয়জন প্রধান শিক্ষক বদলি হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এত দিন মেয়ের মতো স্নেহ–আদরে আগলে রেখেছি। এখন ভুল–বোঝাবুঝি থেকে তারা নানা কথা বলছে। এই বিদ্যালয়ে থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে দোষ নিয়ে যেতে চাই না।’

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, গাফিলাতির পাশাপাশি ওই  প্রধান শিক্ষক বিধি লঙ্ঘন করে একই বিদ্যালয়ে বেশি সময় ধরে আছেন কি না, তদন্ত কমিটিকে সেটিও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।

বৈষম্যের অভিযোগ

আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন নিজেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য করেছেন। তিনি সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের মেয়েদের ‘বিশেষ গুরুত্ব’ দেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করেন রূঢ় আচরণ।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শ্রেণিবৈষম্য ঠেকাতে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্মদিন পালনে বিধিনিষেধ আছে। অথচ নিয়ম ভেঙে অ্যাসেম্বলিতে সব শিক্ষার্থীর সামনে ওই বিচারকের মেয়ের জন্মদিনের কেট কেটেছেন প্রধান শিক্ষক।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন। তিনি বলেন, ওই বিচারক তাঁর মেয়ের জন্মদিনে দুটি কেক পাঠিয়েছিলেন। অ্যাসেম্বলিতেই একটি কাটা হয়েছে। তবে সেখানে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আজ কার কার জন্মদিন। তিনজন মেয়ে হাত তুললে তাদেরও ফুল ও উপহার দেওয়া হয়।

ওসি পরিচয়ে মামলার হুমকি

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেওয়া নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তর্কের পর ওই বিচারকের মেয়ে বাসায় ফিরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। সেখানে সহপাঠীদের ‘বস্তির মেয়ে’ বলে বিদ্রূপ করে।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে, বিচারকের মেয়ের স্ট্যাটাসটি নজরে আসার পর চার শিক্ষার্থী ফেসবুকে পাল্টা স্ট্যাটাস দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই নারী বিচারক প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে ওই চার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবককে মঙ্গলবার বিদ্যালয়ে হাজির করান। এরপর আইসিটি আইনে মামলা করার হুমকি দেন ওই বিচারক।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ওই চারজনের মুঠোফোনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিচয়েও কল দিয়ে মামলার হুমকি দেওয়া হয়।

তবে মুঠোফোনে মামলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আলম সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো ছাত্রীকে কল দেননি।

আরও পড়ুন

তবে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী বলেন, থানার ওসি পরিচয়ে একজন কল দিয়ে আইসিটি আইনে মামলায় কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেন। এরপর সে বিষয়টি পরিবারকে জানায়।

সিসিটিভির ফুটেজ

শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বিদ্যালয়ে অনেকগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে, যেগুলো প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। গত মঙ্গলবার অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওই বিচারকের যা যা ঘটেছিল, তা সিসিটিভি ফুটেজেই রয়েছে।

সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে শিক্ষার্থীরা। তবে প্রধান শিক্ষক মোছা. রাবেয়া খাতুন এখন বলছেন সিসিটিভি ফুটেজ নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। তবে তাঁর কক্ষে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। ফুটেজও নেই।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী বলে, প্রধান শিক্ষকের কক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। পরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে মুছে ফেলা হয়েছে ফুটেজ। ঘটনার দিন রাতে জেলা প্রশাসক আসার পর তারা প্রধান শিক্ষকের কক্ষের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অভিযোগের তদন্ত করার দাবি জানিয়েছিল। তখন প্রধান শিক্ষক এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।