এক ঘণ্টায় হত্যা, লাশ টুকরা করে গুম করতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা

নিহত মিলন হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চর থেকে ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার হওয়া মিলন হোসেন (২৭) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক ছয়জনকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। সন্ধ্যা সাতটায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কুষ্টিয়া সদর আমলি আদালতে ছয়জনের মধ্যে চারজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিচ্ছিলেন। বাকি দুজনের বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ। কাল সোমবার রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানি হবে।

আদালতে নেওয়া আসামিরা হলেন কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি সজীব শেখ (২৪), কুমারগাড়া এলাকার ফয়সাল আহমেদ (২৫), দেশওয়ালীপাড়ার কাজী লিংকন (৩২), সদর উপজেলার কান্তিনগর গ্রামের জনি প্রামাণিক (২১), হাউজিং সি ব্লকের ইফতি খান ও ডি ব্লকের সজল ইসলাম (১৮)। তাঁদের মধ্যে সজল ও ইফতির বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

কুষ্টিয়া মডেল থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় নিহত মিলনের লাশ দাফনের পর তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য থানায় আসেন। পরে নিহত ব্যক্তির মা শেফালি খাতুন বাদী হয়ে কারও নাম উল্লেখ না করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার সময় মিলনের স্ত্রী মিমি খাতুন, দুলাভাই আশরাফুল ইসলামসহ গ্রামের আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।

মামলার বিষয়ে জানতে বাদী শেফালি খাতুন ও মিলনের স্ত্রী মিমি খাতুনের মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তাঁরা ধরেননি। তবে নিহত ব্যক্তির দুলাভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, থানায় গিয়ে ওসির কক্ষের বাইরে ছিলেন তিনি। তাঁর শাশুড়ি ও মিলনের স্ত্রী ওসির কক্ষে ঢুকেছিলেন। মামলায় আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে কি না, তিনি জানেন না।

আরও পড়ুন

গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত পদ্মার চরে অভিযান চালিয়ে মিলনের লাশের টুকরাগুলো উদ্ধার করে পুলিশ। মিলন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাহিরমাদি গ্রামের মাওলা বক্স সরদারের ছেলে। স্ত্রী মিমি খাতুনকে নিয়ে তিনি কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকার ই ব্লকে ভাড়া থাকতেন।

টেক্সটাইল প্রকৌশলে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন তিনি। গত বুধবার সকালে এস কে সজীব নামের এক যুবকের ফোনে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। ওই দিন সন্ধ্যায় মিলনের স্ত্রী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

আরও পড়ুন

যেভাবে মিলনকে হত্যা

থানায় জিডির পর থেকে লাশ উদ্ধার ও জড়িতদের ধরার অভিযানে নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ। পুলিশের এই কর্মকর্তাসহ আরও ২-৩ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত জানা যায়। গ্রেপ্তার আসামিদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফোন করে মিলনকে অফিসে ডেকে নেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার সজল। সেখানে আগে থেকে সজীবসহ কয়েকজন অবস্থান নিয়েছিলেন। অফিসে যাওয়ার পর মিলনের কাছে চাঁদা দাবি করেন সজীব। ভয়ভীতি দেখাতে তাঁকে মারধর করেন। একপর্যায়ে মুখে গামছা গুঁজে নাক চেপে ধরেন। ঘটনাচক্রে মিলন মারা যান।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মিলনকে হত্যার সময় ওই অফিসের দুটি কক্ষে সজীবসহ অন্তত ১০ থেকে ১১ জন ছিলেন। সেখানে দুটি কক্ষে তাঁরা অবস্থান নেন। লাশ গুম করতে সজীব পরিকল্পনার কথা জানান তাঁদের। এ সময় একজনকে সঙ্গে নিয়ে অফিসে তালা লাগিয়ে বাইরে চলে যান। বাকিরা ঘরের ভেতর থাকেন। দেড় ঘণ্টা ধরে শহরের তিনটি দোকান থেকে লাশ কাটার জন্য হেক্সা ব্লেড, পলিথিন ব্যাগ ও রক্ত পরিষ্কারের জন্য জীবাণুনাশক কেনেন। বিকেল পাঁচটার দিকে আবার অফিসে ফিরে আসেন। পরে দুর্বলচিত্তের ৪-৫ জনকে পাশের কক্ষে রাখেন। সজীবসহ ৪-৫ জন মিলে একটি কক্ষের বাথরুমে লাশ নিয়ে টুকরা করেন। প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে লাশ কেটে তাঁরা ব্যাগে ভরেন।

আরও পড়ুন
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস কে সজীব
ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে নয়টার দিকে তাঁরা চারটি মোটরসাইকেলে সাতজন ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসেন। বাকিদের সজীব যে যার মতো বাড়ি চলে যেতে বলেন এবং বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকি দেন। পুলিশ শহরের কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা গেছে, রাত ৯টা ৩২ মিনিটের দিকে চারটি মোটরসাইকেলে সাতজন শহরের ছয়রাস্তা মোড় হয়ে হরিপুর সেতু দিয়ে পদ্মার চরের দিকে চলে যান। রাত ১১টার মধ্যে লাশের টুকরাগুলো পদ্মার চরে বালুচাপা দিয়ে যে যাঁর মতো বাড়ি চলে আসেন। সবাই স্বাভাবিকভাবে শহরে চলাফেলা করতে থাকেন। কেউ পালানোর চেষ্টা করেননি।

যেভাবে জড়িতদের ধরা

জিডির সূত্র ধরে সজলকে থানায় ডেকে নেয় পুলিশ। এরপর তাঁকে উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সারা দিনেও তিনি কোনো তথ্য দেননি। শুক্রবার সকালে সজল থানায় তাঁর এক পরিচিত পুলিশ সদস্যকে মিলনকে হত্যার কথা জানান। এরপর বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতে পারেন। পরে অভিযান চালিয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে সজীবসহ আরও চারজনকে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সজীবকে আটকের পর তাঁর ফোনে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন নেতা ফোন করেন। তখন ফোনটি পুলিশের হেফাজতে ছিল।

আটক ব্যক্তিরা মিলনকে হত্যার কথা অস্বীকার করতে থাকেন। শুক্রবার রাতে সজীব কান্না করতে করতে একপর্যায়ে সব ঘটনা পুলিশকে জানান। ভোররাতে লাশের টুকরা উদ্ধারে যান অন্তত ৫০ জন পুলিশ সদস্য। লাশ গুমের পর লাশ টুকরা করতে ব্যবহৃত যন্ত্র বাধবাজার এলাকায় একটি পুকুরে এবং মিলনের ব্যবহৃত মোবাইল জঙ্গলে ফেলে দেন তাঁরা। সেই ফোন এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

আরও পড়ুন

পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা সবাই একে অপরের পরিচিত। মিলন হাউজিং এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। একই এলাকায় আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে অফিস হিসেবে অনলাইনে কাজ করতেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত ঘটনায় জড়িত ১৩-১৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। আরও অধিকতর যাচাই-বাছাই চলছে। সব আসামিকে ধরা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।