ভাতের বিরান থেকে আখনি

সিলেটের ইফতারির বাজার। জিন্দাবাজার এলাকা থেকে তোলা
ছবি: আনিস মাহমুদ

চল্লিশের দশকের শেষে এখনকার সুপরিচিত আইনজীবী মুজিবুর রহমান চৌধুরী ছিলেন আট বছরের বালক। নগরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা বছর বিরাশির মুজিবুর রহমান সেকালে সিলেটে ইফতারের চল নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন। একদিন জাউ তো অন্যদিন পাতে থাকত পাতলা খিচুড়ি কিংবা ভাতের বিরান (ভাতভাজা)। পাশাপাশি অনেকটা বাধ্যতামূলকই ছিল কাঁচা মরিচ, লবণ আর আদামিশ্রিত কাঁচা ছোলা। পরে মাগরিবের নামাজ শেষেই ভাত খাওয়া চলত।

ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—তিন শাসনামলেই পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িসহ নানা স্থানে ইফতারির আয়োজনে অংশ নিয়েছেন মুজিবুর রহমান। বললেন, সময় বদলেছে। বাজারে কিনতে এখন নানা মুখরোচক ইফতারসামগ্রী মেলে। তবে পাতলা খিচুড়ি, জাউ কিংবা কাঁচা ছোলার ঐতিহ্য অনেক বাড়িতে ঠিকই রয়ে গেছে। এর পাশাপাশি সময়ের পরিক্রমায় ইফতারির থালায় যোগ হয়েছে আরও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার।

মুজিবুর ছাড়াও কথা হলো শহরের আরও পাঁচজন বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁদের বয়স পঞ্চাশ থেকে সত্তরের মধ্যে। তাঁরা জানালেন, চল্লিশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত শহরের বেশির ভাগ বাড়িতে ইফতারির পদ ছিল জাউ, খিচুড়ি ও ভাতের বিরান। অবশ্য প্রায় বাড়িতে ভাতের সঙ্গে নালিয়া (পাটশাক), নিমসহ বিভিন্ন শাক কিংবা লাউ ফুলের বড়া থাকত। বনেদি পরিবারগুলোতে যোগ হতো ছোট-বড় মাছের তরকারি আর রসগোল্লা। কোনো কোনো পরিবারে কালেভদ্রে থাকত পাকা পেঁপে, কলা কিংবা মাঠা। তখন সাদামাটা এমন আয়োজনেই মানুষজন ইফতার সারতেন। পরে নব্বইয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে ইফতারিতে বৈচিত্র্য আসে।

পুরোনো দিনে যেমন বাড়িতেই ইফতারি প্রস্তুত করতেন গৃহিণীরা, এখনো তেমন প্রচলন আছে। মুজিবুর রহমান জানালেন, দেশ স্বাধীনের পর শহরের কিছু দোকানে টুকটাক ইফতারসামগ্রী বেচা শুরু হয়। আশির দশকে ছোলা ভুনা, পেঁয়াজু, খেজুরজাতীয় ইফতারসামগ্রী বিক্রি হতো। নব্বইয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে ইফতারি বেচাকেনায় জৌলুশ বাড়ে। এখন তো হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে অন্তত এক শ পদ ইফতারি বিক্রি হয়ে থাকে।

সিলেটের বাজারে এখন যেসব ইফতারসামগ্রী পাওয়া যায়, এর মধ্যে রয়েছে চিকেন ও বিফ আখনি, পাতলা খিচুড়ি, মাটন ও বিফ হালিম, জিলাপি, শাকের বড়া, চিকেন টিক্কা, কাবাব, রেশমি কাবাব, বিফ চাপ, চিকেন ড্রাম স্টিক, চিকেন উইংস, বিফ বটি কাবাব, বিরিয়ানি, তেহারি, আলু ও ডিমের চপ, পেঁয়াজু, বাখরখানি, ছোলা ভুনা, বেগুনি আর দই-চিড়া।

বৃহস্পতিবার নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় ইফতারি কিনতে আসা সাতজনের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা বললেন, বাসাবাড়িতে এখন নানা পদের ইফতারি প্রস্তুত করা হয়। কিছু পদ কিনে আনা হয়। তবে ছোলা ভুনার সঙ্গে খিচুড়ি কিংবা আখনি আর মিষ্টিজাতীয় ইফতারির মধ্যে জিলাপি সিলেটের অধিকাংশ বাড়িতেই অভিন্ন পদ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ছোট-বড় প্রায় সব হোটেল-রেস্তোরাঁর সামনে শামিয়ানা টানিয়ে নানা পদের ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। চারদিকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের হই-হুল্লোড় আর হাঁকডাক। এ ছাড়া পাড়া-মহল্লার দোকান থেকে শুরু করে ফুটপাতেও ইফতারি বিক্রির ধুম। এর বাইরে খেজুর, মুড়ি, ফলের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেল। তবে ক্রেতাদের অনেকে ইফতারসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বললেন। যদিও বিক্রেতারা বলছেন, সব ধরনের উপকরণের দাম বাড়ায় ইফতারসামগ্রীতেও প্রভাব পড়েছে।

জিন্দাবাজার এলাকার পানসী রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন, তাঁদের রেস্তোরাঁয় বিফ আখনি, পাতলা খিচুড়ি, বিফ নেহারি ও হালিম বেশি বিক্রি হচ্ছে। এই তিন পদ ছাড়াও অন্তত ৩৭ ধরনের ইফতারসামগ্রী তাঁরা বিক্রি করছেন। সিলেটে ইফতারিতে আগেকার ঐতিহ্য যেমন এখনো আছে, তেমনই আধুনিকতার মিশেলেও এখন ইফতারির বাজার জমজমাট বলে তিনি মন্তব্য করলেন।

ইফতারির প্রসঙ্গ তুলতেই নগরের রায়নগর সোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দা কলাম লেখক রফিকুর রহমান (লজু) (৭৮) শৈশবের স্মৃতিচারণা করলেন। বললেন, তাঁরা শৈশবে খিচুড়ি, ছোলা ভুনা, পেঁয়াজু আর খেজুর দিয়েই সাধারণত ইফতার সারতেন। প্রায় বাড়িতে লেবুর শরবতও থাকত। মূলত ঘরেই তখন ইফতারি তৈরি হতো। তবে দেশ স্বাধীনের পর শহরের কিছু রাস্তার মোড়ে মাটির চুলায় পেঁয়াজু তৈরি করে দোকানিরা গরম–গরম বিক্রি করতেন। তাঁরা ছোলা ভুনাও বেচতেন, তবে তা বাড়ি থেকে আগেই তৈরি করে আনতেন। এ দুটো পদই ইফতারসামগ্রী হিসেবে তখন বিক্রি হতো। আর এখন ইফতারিতে যোগ হয়েছে মুখরোচক কতশত পদ।