জাল বেচে জাহাজের মালিক রবিউল

নিজের কারখানায় জাল প্রস্তুত করেন রবিউল ইসলাম। শ্রমিকদের জাল তৈরিতে দেন নানা পরামর্শ। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ইছানগরের মৎস্য বন্দরেছবি : প্রথম আলো

সমুদ্রের অবিরাম গর্জনের ভেতর দাঁড়িয়ে তরুণ রবিউল ইসলাম তখনো বুঝতে পারেননি—এই ঢেউ একদিন তাঁর জীবনের দিকটাই পাল্টে দেবে। একসময় গভীর সাগরের জাহাজে নাবিক ছিলেন তিনি। টানা জাল ওঠানো-নামানোর সময় শরীর ভিজে যেত, হাতের চামড়া উঠে যেত। কিন্তু জালের সঙ্গে অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়েছিল। সেই টানই পরে তাঁকে ‘জালের বিশেষজ্ঞ’ বানায়। আর এখন সেই জাল বিক্রি করেই কিনেছেন আস্ত এক গভীর সমুদ্রগামী মৎস্য জাহাজ।

চলতি বছরের মে মাসে রবিউল মাছ ধরার জাহাজটি কিনেছেন। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ মিটার, প্রস্থ ৮ মিটার। অর্থাৎ লম্বায় এটি ১২-১৩ তলা ভবনের সমান। জাহাজটি নির্মিত হয়েছে চীনে, তবে কেনা হয়েছে দেশের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এই জাহাজে শতাধিক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়; কাজ করেন ৪৫ জন কর্মী।

কীভাবে নাবিক থেকে জাহাজমালিক—এই গল্পের শুরুতে ফিরে যেতে হয় ২০০৬ সালে। ওই বছর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী থেকে চট্টগ্রামে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এলেন রবিউল। ভাই তখন মাছ ধরার জাহাজে চাকরি করেন। একদিন তাঁর সঙ্গে বেড়াতে গেলেন সাগরে।

সেই প্রথম সমুদ্রদর্শন। জলরাশির গর্জন, হিমেল বাতাস আর অজানা এক টানের ভেতর পড়ে গেলেন তিনি। একই বছর ভাইয়ের সুবাদে ‘এফভি জারান’ জাহাজে চাকরি হয়ে যায় তাঁর। কাজ ছিল জাল দেখাশোনা।

জালের সুই-সুতা থেকে দড়ির টান, কোন নকশায় কোন ফাঁস—এসব তিনি যেন চোখ বুজেই বুঝে ফেলতেন। জাল পানিতে কীভাবে খুলে যায়, কীভাবে তলায় আচরণ করে—এসব নিয়ে তাঁর কৌতূহল বাড়তেই থাকে।

২০০৮ সালের দিকে একটি কোম্পানিতে ‘নেট টেকনিশিয়ান’ হিসেবে চাকরি পান। শুরুতে শুধু মেরামত করলেও কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন নকশা ও সংযোজনের দায়িত্ব তাঁর হাতে আসে। জালের কারিগরিতে তখনই খুলে যায় এক নতুন পথ।

সেই প্রথম সমুদ্রদর্শন। জলরাশির গর্জন, হিমেল বাতাস আর অজানা এক টানের ভেতর পড়ে গেলেন তিনি। একই বছর ভাইয়ের সুবাদে ‘এফভি জারান’ জাহাজে চাকরি হয়ে যায় তাঁর। কাজ ছিল জাল দেখাশোনা।

যেভাবে ‘উদ্যোক্তা’ রবিউল

২০১২ সাল। চাকরি করে হাতে সামান্য কিছু টাকা জমেছে। রবিউল সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেই কারখানা দেবেন। এরপর কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে ইছানগর মৎস্য বন্দরের এক কোণে ছাউনি ও গুদাম ভাড়া নেন। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন—রবিউল মডার্ন ট্রল লিমিটেড। শুরুটা ছিল কঠিন। নকশা, কাটা, সংযোজন—সবটুকুই করতেন একা হাতে।

জাহাজের ইঞ্জিনের অশ্বশক্তি, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, পানি কত গভীরে ঢুকবে, সব হিসাব করে তবেই শুরু হয় নকশা। এরপর বিদেশ থেকে আনা ফেব্রিকস কাটেন ২২ ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে। একটি পরিপূর্ণ ট্রল (টানা জাল) নেট তৈরি হতে সময় লাগে এক থেকে দুই সপ্তাহ। দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। দৈর্ঘ্য ৪০৫ থেকে ৪৮০ ফুট। বছরে তিনি অন্তত ১০০টি নতুন জাল তৈরি করেন, মেরামত করেন আরও ৩০০টির মতো।

গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাট প্রান্ত থেকে নৌকায় নদী পেরিয়ে তাঁর কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, ব্যস্ততা তুঙ্গে। কেউ জাল বুনছেন, কেউ ভাঁজ করছেন। জাহাজমালিকদের প্রতিনিধিরা আসছেন জাল নিতে। রবিউল নিজে আঙুলে মাপ নিচ্ছেন, দড়ির টান ঠিক করছেন। প্রতিটি জাল তুলে দিচ্ছেন সাবধানে।

এক ক্রেতা বললেন, ‘রবিউলের নকশার জাল পানিতে গতি পায় ভালো। জালগুলো চওড়া হয় বেশি, আবার হালকাও। ফলে মাছ বেশি ধরা পড়ে, ইঞ্জিনে চাপও কম পড়ে।’

বিদেশ থেকে আনা ফেব্রিকস কাটেন ২২ ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে। একটি পরিপূর্ণ ট্রল (টানা জাল) নেট তৈরি হতে সময় লাগে এক থেকে দুই সপ্তাহ। দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। দৈর্ঘ্য ৪০৫ থেকে ৪৮০ ফুট। বছরে তিনি অন্তত ১০০টি নতুন জাল তৈরি করেন, মেরামত করেন আরও ৩০০টির মতো।
রবিউল ইসলামের জাহাজ এফ ভি স্পিড-২
ছবি : প্রথম আলো

কথা বলতে বলতে রবিউল ফিরে গেলেন শুরুতে। তিনি বলেন, ‘নিজের নকশা নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের দরজায় গিয়েছি। কেন আমার জাল অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা, এটা বোঝাতে চেষ্টা করেছি। বেশির ভাগ জায়গা থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে।’

শুরুর দিনের সেই ‘দমবন্ধ’ অবস্থা মনে করে রবিউল যোগ করেন, ‘কারখানা শুরুর সময় ক্রেতা ছিল না। কাজও ছিল না। শুধু অপেক্ষা আর চিন্তা। রাতে ঘুম আসত না। মনে হতো, ভুল পথে হাঁটছি না তো? কিন্তু হাল ছাড়িনি। একেকটা অর্ডার তখন নতুন শ্বাসের মতো ছিল। ধীরে ধীরে আস্থা বাড়ল, রোজগারও বাড়তে থাকল।’

বর্তমানে দেশে মাছ ধরার জাহাজ রয়েছে প্রায় ২৫৫টি। নিয়মিত চলাচল করে ২২০টি। এর মধ্যে অন্তত ১৪০টি জাহাজে রবিউলের বানানো জাল ব্যবহৃত হয়। সরকার অনুমোদিত চার ধরনের জালই তৈরি করেন তিনি। উপকরণগুলো আমদানি করা হয় বিভিন্ন দেশ থেকে।

নিজের নকশা নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের দরজায় গিয়েছি। কেন আমার জাল অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা, এটা বোঝাতে চেষ্টা করেছি। বেশির ভাগ জায়গা থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে।
রবিউল

রবিউলের কারখানায় জাল তৈরির খুঁটিনাটি শিখতে এখন অনেকেই আসেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকবার এসেছেন। রবিউল এই শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শিখিয়ে দেন জাল তৈরির নানা দিক।

অবশেষে স্বপ্নের জাহাজ

জাল বানাতে বানাতে একসময় তাঁর মাথায় জাহাজ কেনার স্বপ্ন ঢুকে পড়ে। ভাবতে থাকেন, যে জাহাজে একসময় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন, এবার সে ধরনের একটি জাহাজ কিনবেন। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, একরাশ আত্মবিশ্বাস আর সঞ্চিত অর্থ—সব মিলিয়ে চলতি বছর তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়।

রবিউল বলেন, ‘জাহাজে ভাসতে ভাসতে ভাবতাম, একদিন আমারও এমন একটা জাহাজ হবে। সেই স্বপ্ন পূরণে লেগে ছিলাম।’ সাধারণত ছোট থেকে মাঝারি আকারের মাছ ধরার জাহাজের দাম ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা। পুরোনো জাহাজের দাম আরও কম।

আমার ছেলে খুব পরিশ্রমী। দিন-রাত এক করে কাজ করে। আল্লাহ চাইলে সামনে আরও ভালো করবে।
সজিদা বেগম, রবিউলের মা

সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে রবিউল ফিরে তাকান পুরোনো দিনের দিকে। সেই শ্রমিক-দিনগুলোর কষ্ট, পরিশ্রম; সবই তাঁকে টেনে এনেছে আজকের জায়গায়। ঢেউ যেমন বারবার ফিরে আসে, তেমনি তাঁর জীবনে ফিরে এসেছে সেই শ্রমিক-দিনগুলোর স্মৃতি। সে স্মৃতি হাতড়ে রবিউল বলেন, ‘মানুষের ভাগ্যও জালের মতো। ঠিকভাবে বোনা গেলে একসময় শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।’

কর্ণফুলী উপজেলায় পরিবার নিয়ে থাকেন রবিউল। পরিবারে মা সজিদা বেগম, স্ত্রী আফসানা আক্তার ও দুই সন্তান। মা সজিদা বেগম জাহাজ কেনার খবর শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলেন। তাঁর চোখ ভিজে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে খুব পরিশ্রমী। দিন-রাত এক করে কাজ করে। আল্লাহ চাইলে সামনে আরও ভালো করবে।’