খুন-অস্ত্রবাজিতে রয়েছে তিন স্তরের সন্ত্রাসী, নির্দেশ আসে বিদেশ থেকে

২০০০ সালের ১ অক্টোবর একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদফাইল ছবি

এক দল খুন, অস্ত্রবাজির পরিকল্পনা করে। আরেক দল সরাসরি হত্যা–অস্ত্রবাজিতে অংশ নেয়। অন্যরা ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকে। তিন ভাগে ভাগ হয়ে চট্টগ্রামে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলীর অনুসারীরা। পরিকল্পনা, হামলা ও অস্ত্রবাজির পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হয় তিন ভাগে সাজানো একটি বাহিনীর মাধ্যমে—‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে বিভক্ত সন্ত্রাসীদের নিয়ে। বিদেশে বসে নির্দেশনা দেন সাজ্জাদ।

৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে এক ব্যবসায়ীর বাসায় গুলিতে অংশ নেওয়া ইফতেখার ইবনে ইসহাক নামের এক সন্ত্রাসীকে ৪ ডিসেম্বর গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ এসব তথ্য জানতে পারে। দীর্ঘ দুই দশক ধরে দেশের বাইরে বসেই সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী নিয়ন্ত্রণ করছেন নগর ও জেলার বিস্তৃত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক।

কে এই সাজ্জাদ

চালিতাতলী এলাকার ঠিকাদার আবদুল গণির ছেলে সাজ্জাদ আলী মূলত অপরাধজগতে পরিচিত হন ১৯৯৯ সালে কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খান খুনের পর। মামলায় সাক্ষ্য না পাওয়ায় খালাস পেলেও নগরের অপরাধজগতে তাঁকে নিয়েই শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়।

২০০০ সালের ১২ জুলাই বহদ্দারহাটে ছাত্রলীগের ছয় নেতা–কর্মীসহ আটজনকে ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। ‘এইট মার্ডার’ নামে পরিচিত সেই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাজ্জাদ—এ অভিযোগ ওঠে বহুবার। একই বছরের অক্টোবরে একে–৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। পরে জামিনে বেরিয়ে ২০০৪ সালে দেশ ছাড়েন। তার পর থেকেই বিদেশে বসে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন তাঁর বাহিনী। অবশ্য ‘এইট মার্ডার’ মামলা থেকে খালাস পান তিনি।

শুরুতে নুরনবী ম্যাক্সন, সরোয়ার হোসেন, আকবর আলী ও ছোট সাজ্জাদকে নিয়ে গড়ে ওঠে এই বাহিনী। ম্যাক্সন ভারতে মারা যান, সরোয়ার দল ছাড়েন। এরপর ২০১৫ সাল থেকে নেতৃত্ব নেন ছোট সাজ্জাদ।

সাজ্জাদ বাহিনীর বর্তমান কার্যক্রম পরিচালিত হয় মোবারক হোসেন ইমন ও মোহাম্মদ রায়হানের নেতৃত্বে
ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

নতুন নেতৃত্বে রায়হান–মোবারক

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, বড় সাজ্জাদের বাহিনীতে সক্রিয় রয়েছেন অন্তত ৫০ জন শুটার ও সহযোগী। ছোট সাজ্জাদ কারাগারে যাওয়ার (১৫ মার্চ) পর নেতৃত্ব আসে ১৫ মামলার আসামি মোহাম্মদ রায়হান ও মোবারক হোসেন ওরফে ইমনের হাতে।

দলে আরও রয়েছেন খোরশেদ, ভাতিজা মোহাম্মদ, নাজিম উদ্দিন, ববি আলম, কামাল, হাসান, নুরুল হক, বোরহান, মবিন, কাদের, তপু, আজম, মনির, তুষার, তুহিন, সোহেল, ছালেক ও এরশাদ—যাঁদের অধিকাংশই অস্ত্র চালনায় বিশেষ দক্ষ। বিদেশ থেকে ফোনে নিয়মিত নির্দেশনা পাঠান সাজ্জাদ।

আরও পড়ুন
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, বড় সাজ্জাদের বাহিনীতে সক্রিয় রয়েছেন অন্তত ৫০ জন শুটার ও সহযোগী। ছোট সাজ্জাদ কারাগারে যাওয়ার (১৫ মার্চ) পর নেতৃত্ব আসে ১৫ মামলার আসামি মোহাম্মদ রায়হান ও মোবারক হোসেন ওরফে ইমনের হাতে।

৫ আগস্টের পর বেপরোয়া হামলা

গত বছরের ৫ আগস্ট ছোট সাজ্জাদ, রায়হানসহ কয়েকজন জামিনে বেরিয়ে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে বাহিনী।

২৯ মার্চ বাকলিয়া এক্সেস রোডে সরোয়ারকে লক্ষ্য করে গুলি করলে প্রাইভেট কারে থাকা দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। এরপর বায়েজিদ, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, হাটহাজারী ও রাউজানে চাঁদার জন্য প্রকাশ্যে গুলি করে আতঙ্ক ছড়ায় বাহিনী। এ রকমই অন্তত ১৫টি গুলির ঘটনা ঘটেছে।

৫ নভেম্বর বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর গণসংযোগে হামলায় গুলিবিদ্ধ হন পাঁচজন। নিহত হন সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা। ওই মামলায় বড় সাজ্জাদ, রায়হান, ইমনসহ ২২ জনকে আসামি করেছেন সরোয়ারের বাবা।

সন্ত্রাসীদের হামলা শুধু নগরেই নয়—২২ এপ্রিল রাউজানের গাজীপাড়ায় যুবদল কর্মী ইব্রাহিমকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৯ আগস্ট অক্সিজেন–পশ্চিম কুয়াইশে মো. মাসুদ ও মো. আনিছকে খুন করা হয়। এর এক মাস পর চান্দগাঁওয়ে চায়ের দোকানে বসে ইট–বালু ব্যবসায়ী তাহসীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২৩ মে পতেঙ্গা সৈকতে সন্ত্রাসী আকবর আলীকে খুনের মামলাতেও রায়হানকে আসামি করা হয়। ৫ আগস্টের পর রায়হান ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে খুনসহ ১৪টি মামলা হয়।

আরও পড়ুন
বিদেশে পলাতক সাজ্জাদের গড়ে তোলা এই বাহিনীই নগর ও জেলায় খুন, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত হয়ে তারা পরিকল্পনা ও হামলা চালায়। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।
কাজী মো. তারেক আজিজ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল)।

তিন স্তরের কাঠমো

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রায়হান–মোবারক এখন নিজেরা গুলি চালান না। সাজ্জাদের নির্দেশে তাঁরা আলাদা জায়গায় বসে পরিকল্পনা করেন। এরা ‘এ’ ক্যাটাগরির।

খুন ও বড় হামলার ক্ষেত্রে ‘বি’ ক্যাটাগরির শুটাররা অংশ নেন—যেমন কাদের, নাজিম, বোরহান। আর আশপাশ পাহারা দেওয়া ও পালিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে ‘সি’ ক্যাটাগরি।

৪ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ইফতেখার জানান, ২০ আগস্ট হাটহাজারীতে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গুলির ঘটনায় তিনি ছিলেন ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। কিন্তু সরোয়ার হত্যায় ছিলেন ‘সি’ ক্যাটাগরিতে—শুধু আশপাশে ঘোরাফেরা করতেন। কোন ঘটনায় কে ‘বি’ বা ‘সি’ ক্যাটাগরিতে থাকবেন—তা নির্ধারণ করেন রায়হান ও মোবারক। বর্তমানে রায়হান ভারতে, মোবারক আছেন দেশে।

৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে এক ব্যবসায়ীর বাসায় গুলিতে অংশ নেওয়া ইফতেখার ইবনে ইসহাক। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁকে
ছবি: পুলিশের সৌজন্যে

বিদেশে বসে খুন–চাঁদাবাজির অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সাজ্জাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশে ব্যবসা করি, দেশে ভাড়া ঘর থেকেও আয় আছে। আমাদের পরিবার বিত্তশালী। আমি কেন বাহিনী তৈরি করব? উল্টো আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।’ তিনি দাবি করেন, ছোট সাজ্জাদ বা রায়হানের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে পলাতক সাজ্জাদের গড়ে তোলা এই বাহিনীই নগর ও জেলায় খুন, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত হয়ে তারা পরিকল্পনা ও হামলা চালায়। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।

আরও পড়ুন