নগরকান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের অধিকাংশ পদই শূন্য, অস্ত্রোপচার হয় না ৪৫ বছর 

এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অবেদনবিদ না থাকায় অস্ত্রোপচারসেবা চালু করা যায়নি। এখানে চিকিৎসকের ১৪টি পদ শূন্য। 

শয্যা না থাকায় ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায় রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত সোমবার তোলা ছবি
প্রথম আলো

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের অধিকাংশ পদই শূন্য। অবেদনবিদন নিয়োগ না দেওয়ায় এখানে ৪৫ বছর ধরে কোনো অস্ত্রোপচার হয় না। ফলে এই হাসপাতালে এসে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। এখানে শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। এ কারণে রোগীদের ওয়ার্ড কিংবা বারান্দার মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এভাবে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীরা ভোগান্তি পোহান। 

সম্প্রতি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে রোগীদের জন্য ১২টি শৌচাগার রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিই ব্যবহারের অনুপযোগী। এতে রোগী ও তাঁদের স্বজনদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ছাড়া এই হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে কোনো শৌচাগার নেই। অথচ এই ওয়ার্ডের রোগীদেরই শৌচাগারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি সালথার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের কাগদি গ্রামের ফরিদ মাতব্বর বলেন, ‘ডায়রিয়ার রোগী হওয়ায় বারবার টয়লেটের বেগ পায়। অখচ এখানে কোনো টয়লেট নাই। বারান্দায় যে কয়টি টয়লেট রয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই ব্যবহারের অনুপযোগী। যেটা চালু আছে, সেটারও যা তা অবস্থা। দেখেই আবার বমি আসার উপক্রম হয়।’ 

নগরকান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ১৯৭৮ সালে নগরকান্দা উপজেলা সদরের নগরকান্দা-কাইলার মোড় সড়কের গাঙজগদিয়া মহল্লায় ২১ একর জমির ওপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথমে এটি ৩১ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে চালু হলেও ২০০৬ সালে এটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু এখানে ৫০ শয্যার অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। ৫০ শয্যার জনবলকাঠোমো অনুমোদন করা হলেও অধিকাংশ পদ শূন্য রয়েছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যালয় সূত্র জানায়, ৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ২২টি। কিন্তু এখানে কর্মরত আছেন আটজন। চিকিৎসকের ১৪টি পদ শূন্য রয়েছে। এগুলো হচ্ছে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞের ৯টি পদ (অ্যানেসথেসিয়া, মেডিসিন, সার্জারি, নাক-কান-গলা, শিশু, কার্ডিওলজি, চক্ষু, অর্থোপেডিক, চর্ম ও যৌন) এবং সহকারী সার্জন, ডেন্টাল সার্জন ও তিনটি চিকিৎসা কর্মকর্তার পদ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পুরুষ ওয়ার্ডে ১২টি, মহিলা ওয়ার্ডে ১২টি, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৬টি, বারান্দায় ১৭টি ও ২টি কেবিনে ২টিসহ মোট শয্যা ৪৯টি। তবে রোগীর সংখ্যা বেশি হলে মেঝেতে রোগী রেখেও চিকিৎসাসেবা দিতে হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এ এইচ এম নূরুল ইসলাম খান সাময়িকভাবে বরখাস্ত অবস্থায় আছেন। সহকারী সার্জন ফালগুনী আহমেদ বর্তমানে ফরিদপুর ট্রমা সেন্টারে সংযুক্তিতে রয়েছেন। আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতল ভবনের নিচতলা জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ। নিচতলায় রোগী ও তাঁদের স্বজনদের ব্যবহারের জন্য কোনো শৌচাগার নেই।

দ্বিতীয় তলায় মহিলা, পুরুষ ও ডায়রিয়া ওয়ার্ড। এ ছাড়া এখানে দুটি কেবিন রয়েছে। একটি কেবিন সাধারণ এবং অপরটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত। দ্বিতীয় তলায় বারান্দায় ফোমের জাজিম মেঝেতে পেতে শয্যা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বারান্দায় বৈদ্যুতিক পাখা নেই।

অনেক রোগীই ওয়ার্ডে শয্যা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে বারান্দার শয্যায় চিকিৎসা নেন। সম্প্রতি এখানে চিকিৎসা নিতে আসা এক শিশুর মা উপজেলার পুরাপাড়া ইউনিয়নের পুরাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মিলি বেগম (৩২) জানান, তিনি তাঁর তিন বছর বয়সী মেয়ে সাদিয়া আক্তারকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। হাসপাতালের ভেতরে জায়গা না পেয়ে তিনি রয়েছেন বারান্দায়। তিনি বলেন, ‘ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আমি একা মানুষ দুই দিন ধইরা হাসপাতালে আছি। ভর্তির দিন মহিলা ওয়ার্ডে জায়গা ফাঁকা ছিল না। এ জন্য বাইরে থাকতে হচ্ছে।’

লস্করদিয়া ইউনিয়নের জুঙ্গুরদি গ্রামের জুথি আক্তার (১৫) ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ২৬ আগস্ট। তার সঙ্গে এসেছেন মা সকিনা বেগম। সকিনা বেগম (৫৪) বলেন, ‘দুই দিন ধইরা ভর্তি হইয়া উপরে বেড পাই নাই। নিচে জায়গা হইছে তোশকও দেয় নাই। হাসপাতাল থেকে দিছে শুধু একটা চাদর। এই চাদর বিছায়ে বাড়ি থেকে বালিশ এনে কোনোমতে চিকিৎসা নিচ্ছি। এই ভোগান্তিতে আমিই রোগী হইয়া যাইতেছি।’

২৮ আগস্ট সরেজমিনে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগের চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে ২০-২৫ জন রোগী লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। তাঁরা সিরিয়াল অনুযায়ী চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকছেন।

হাসপাতালের দোতলায় পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড এবং বারান্দায় ১২টি শৌচাগার রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি চালু রয়েছে। মহিলা ওয়ার্ডের তিনটির মধ্যে একটি, বারান্দার ছয়টির মধ্যে একটি এবং পুরুষ ওয়ার্ডে তিনটিই চালু রয়েছে।

ডায়রিয়া ওয়ার্ডে দুটি বৈদ্যুতিক পাখা রয়েছে। ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন নগরকান্দার পুরাপাড়া ইউনিয়নের বড় কাজুলি গ্রামের ফরিদ সরকার (৪১)। তিনি বলেন, এখানে ছয়টি শয্যা। কিন্তু মাত্র দুটি ফ্যান। ফ্যান কম থাকায় রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। তিনি আরও বলেন, ওয়ার্ডের ছয়টি শয্যার মধ্যে একটি শয্যায় স্যালাইন টাঙানো স্ট্যান্ড রয়েছে। বাকি পাঁচটিতে নেই। এতে সব রোগীর যখন স্যালাইন নিতে হয়, তখন ওই একটি স্ট্যান্ড নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসাসেবার দিক থেকে গত এপ্রিলে অবস্থানের দিক থেকে সবচেয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল। তবে গত মে ও জুন মাসে সবার চেষ্টায় সেবার মানের উন্নতি ঘটে। জুন মাসে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থান জেলার মধ্যে ১ নম্বরে উঠে এসেছে। জুন মাসে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে ১ হাজার ২২৭ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ২৬ জন রোগী। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫ হাজার ৯৪৩ জন। আর জুলাই মাসে জরুরি বিভাগে ১ হাজার ১৯৬ জন, বহির্বিভাগে ৬ হাজার ৬৭০ জন এবং অন্তর্বিভাগে ২ হাজার ২৭৪ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রসূতিদের স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে সুযোগ থাকলেও অবেদনবিদ না থাকায় সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার হয় না। গত এপ্রিলে স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম হয়েছে ২৫টি, মে মাসে ৩২টি, জুন মাসে ৩৬টি ও জুলাই মাসে ৪১টি।

এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি আগে থেকেই ছিল। নতুন তিনজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট যোগ দেওয়ায় প্যাথলজির সব কাজ চালু হয়েছে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। তাই এখানে রক্ত, ডায়াবেটিস সব ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সহজেই করা যাচ্ছে। 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সূত্র জানায়, হাসপাতালের মূল ভবনটি এক বছর আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে ওই ভবনেই রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ২৮ আগস্ট সরেজমিন দেখা যায়, ভবনের বিভিন্ন কক্ষের ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ছাদের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তার উঠে গেছে।

জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তানসিভ জুবায়ের বলেন, ১৯৭৮ সালে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চালু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো অস্ত্রোপচার করা হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শয্যা, জনবল ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। জনবল চেয়ে বারবার সিভিল সার্জনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনটি এক বছর আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন একটি ভবন বরাদ্দ হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবহারের অনুপযোগী শৌচাগারগুলো চালু করার কোনো সুযোগ নেই।