তিস্তার তীরে আপনারা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এই কর্মসূচি নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী? কেন মনে হলো এ রকম একটি কর্মসূচি হওয়া দরকার?
আসাদুল হাবিব: এটা নতুন ভাবনা নয়। এটা এই অঞ্চল ও জনপদের মানুষের দাবি। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানির ন্যায্যতা ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার জন্য আন্দোলন করেছেন। এত দিন স্বৈরশাসকের কারণে আমরা কথা বলার স্বাধীনতা পাইনি। সমাবেশ তো দূরের কথা, একসঙ্গে জমায়েত হওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন মুক্ত বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের বঞ্চিত রংপুরবাসীর জন–আকাঙ্ক্ষিত দাবি নিয়ে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।
আপনাদের দাবি কী কী?
আসাদুল হাবিব: আমরা ৪৮ ঘণ্টার জনতার সমাবেশের আহ্বান জানিয়েছি। আমাদের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে রংপুর বিভাগের ৫টি জেলা—রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের হাজারো লোক জমায়েত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমরা মনে করি, জমায়েতের মধ্য দিয়ে তিস্তা নদী খনন করা, বাঁধ দেওয়া ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে এ অঞ্চলে স্যাটেলাইট শহর, অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে হবে।
এই কর্মসূচিকে ঘিরে আপনারা তিস্তাপারের ৫ জেলার পথেঘাটে পথসভা, পথযাত্রা ও সমাবেশ করলেন। এসব কর্মসূচিতে মানুষের সাড়া কেমন পেলেন?
আসাদুল হাবিব: এই আন্দোলন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের নয়। এটি হলো গোটা রংপুরবাসীর আন্দোলন। এই আন্দোলন মানুষের কল্যাণে ও জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। এ জনপদের সব শ্রেণি–পেশার মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমরা আশা করছি, এই দুদিন ব্যাপক লোকসমাগম ঘটবে।
কর্মসূচিতে কারা থাকবেন?
আসাদুল হাবিব: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ৫ জেলার ১১টি পয়েন্টে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৭ ফেব্রুয়ারি তিস্তাপারে আসবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ (টুকু), দলের সহসভাপতি শামসুজ্জামান (দুদু), বরকতউল্লা (বুলু), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও মোয়াজ্জেম হোসেন (আলাল) থাকবেন।
অন্য দলের কেউ থাকবেন?
আসাদুল হাবিব: বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
আপনারা তিস্তার কোন সমস্যাকে প্রধান হিসেবে দেখছেন?
আসাদুল হাবিব: আমরা প্রধানত দুটি সমস্যা দেখি। একটি হচ্ছে তিস্তার ন্যায্য পানির দাবি; যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে পতিত সরকার কোনোভাবেই চুক্তি করতে পারেনি। আরেকটি হচ্ছে, তিস্তার ভাঙন রোধ। ভাঙনের হাত থেকে লোকজনকে রক্ষা করার জন্য তিস্তাকে নদীশাসনের আওতায় নিয়ে আসা।
আপনি তিস্তার পানি পাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু ভারতের সরকার তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে আসছে। তিস্তার পানি আমরা কীভাবে পেতে পারি?
আসাদুল হাবিব: তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সেখানে পানি আটকে রাখার কোনো বিধান নেই। ভারত জোর করে আমাদের পানি আটকে রেখেছে। আমাদের হিস্যার পানি দিতে হবে। এটা আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে। একবার আলোচনাও হয়েছিল, শুষ্ক মৌসুমে অর্ধেক পানি ভারত রাখবে, অর্ধেক বাংলাদেশকে দেবে। বর্ষা মৌসুমে ২ লাখ কিউকেস পানি আসে, সেখানে শুষ্ককালে মাত্র ১ হাজার কিউসেক পানি দেওয়া হয়। সুতরাং যৌথ নদী কমিশনের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। না হলে সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তুলতে হবে।
তিস্তা বিষয়ে ‘পাওয়ার চায়না’ কর্তৃক প্রণীত একটি পরিকল্পনার কথা ২০১৬ সাল থেকে শোনা যাচ্ছিল। আপনারা কি ওই পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন চাচ্ছেন?
আসাদুল হাবিব: ওনারা (পাওয়ার চায়না) একটি সমীক্ষা করেছিল। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতে একটি নকশাও দিয়েছিল। সমীক্ষায় তারা উল্লেখ করে, তিস্তা নদী প্রশস্ত হয়েছে গড়ে সাড়ে ৮ কিলোমিটার। এটাকে কমিয়ে তারা দেড় কিলোমিটারে নিয়ে আসতে চায়। তাহলে তিস্তার দুই পারের লাখো হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। তারা বলেছে, নদীর দুই ধারে গাইড দিয়ে রাস্তা প্রশস্ত করে দেবে। তাদের নকশার মধ্যে ছিল স্যাটেলাইট শহর, হাউজিং, অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটন। নদীতে নৌযান চলাচল করবে।
আপনাদের নিজস্ব কোনো সমীক্ষা আছে?
আসাদুল হাবিব: আমাদের এ ব্যাপারে কোনো সমীক্ষা নেই। যারা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ, তাঁদের করতে হবে। আমরা দাবি করছি, তিস্তা নদীর যে মরা দশা হয়েছে, এটা বিলুপ্তপ্রায়—এই নদীকে জাগিয়ে তোলা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন চীনের এই প্রকল্প নিয়ে আপত্তি তুলেছে। তারা বলছে, তিস্তার মতো একটি বিনুনী নদীর প্রশস্ততা কমানো হলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?
আসাদুল হাবিব: পরিবেশবাদীরা কীভাবে বলছেন, আমি জানি না। কিন্তু এখন আপনি গিয়ে দেখবেন, তিস্তার বাস্তব অবস্থা আট বা সাড়ে আট কিলোমিটার চওড়া (প্রশস্ত)। শুধু ধু ধু বালু। এখানে পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। দেড় কিলোমিটারে নিয়ে এলে এটা অবশ্যই খনন করতে হবে। গভীরতা থাকবে। গভীরতা থাকলে পানি সংরক্ষণের অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।
তিস্তার মতো নদীর মিঠাপানি ধরে রাখলে সুন্দরবনসহ দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা বাড়ার ঝুঁকি আছে? বাস্তুতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনে এর প্রভাব পড়তে পারে?
আসাদুল হাবিব: তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য দাবি। ভারতের এটা মেনে নেওয়া উচিত। আগে নতজানু সরকার ছিল, সেভাবে দাবি তুলতে পারেনি। আমরা মনে করি, এখন দাবি করার সময় এসেছে। আমাদের হিস্যার পানি দিলে সমস্যা থাকবে না। আমরা একটি জনকল্যাণ ও জনবান্ধব প্রকল্প চাচ্ছি। যেগুলো চ্যালেঞ্জ আসবে, সেগুলোকে সেভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
আমরা দেখছি, বড় বড় কিছু কোম্পানি তিস্তার জমি দখল করেছে। নীলফামারীর ডিমলা থেকে শুরু করে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ, রংপুরের গঙ্গাচড়া, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তার চরের জমি দখল হয়েছে। বিষয়টি আপনাদের নজরে আছে?
আসাদুল হাবিব: আমার বক্তব্যে বলেছি, যাঁরা এসব চরে সৌরবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্প করেছেন, তাঁরা স্বৈরশাসকের দোসর ছিলেন। স্বৈরশাসক সুবিধা দিয়েছে। জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি ছিল না। কোন আইনে দিল, কিসের ভিত্তিতে দিল, আমরা এটাও জানি না। আমরা এই আন্দোলন করছি, কৃষক ও তিস্তাপারের মানুষকে বাঁচানোর জন্য। ভূমিহীন, গরিব, নিম্নবিত্ত— তিস্তাপারের পরিবারগুলো নদীভাঙনে ছিন্নমূলে পরিণত হয়েছে। সুতরাং তাঁদের স্বার্থ আগে রক্ষা করতে হবে।
৯ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টা তিস্তাপারে এসে গণশুনানিতে অংশ নিলেন। একজন উপদেষ্টা নদীভাঙন রোধে প্রকল্প নেওয়ার ঘোষণা দেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আসাদুল হাবিব: মহাপরিকল্পনা বলি আর মেগা প্রকল্প বলি, এটা বৃহৎ বিষয়। এটার সমীক্ষা, নকশা ও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ওনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে কাজগুলো করতে চায়, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, তিস্তাপারে বিচ্ছিন্ন ভাবে জিওব্যাগ ফেলানো হয়েছে, স্পার বানানো হয়েছে। কিন্তু নদী ভাঙন ঠেকানো যায়নি। আমার মনে হয়, জনগণের ট্যাক্সের টাকা এভাবে অপচয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা চাই, সম্মিলিত ও সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা।
তিস্তাকে ঘিরে আগামী দিনের রাজনীতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। দুই উপদেষ্টার কর্মসূচিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেনসহ অন্য নেতারা ছিলেন। সেখানে বিএনপিরও অংশগ্রহণ ছিল। আবার আপনারা আলাদাভাবে কর্মসূচি দিলেন...
আসাদুল হাবিব: এটাকে আমরা সামাজিক আন্দোলন বলছি। রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে যাঁরা এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে তিস্তা নিয়ে দাবি উচ্চারণ করতে চাই।
সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আসাদুল হাবিব: আপনাকেও ধন্যবাদ।