মানুষ দেখলেই ছুটে আসে যমুনা, চায় আদর-ভালোবাসা

দর্শনার্থীদের সঙ্গে খুনসুটি করছে হাতিশাবক যমুনা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে
ছবি: প্রথম আলো

ঘন জঙ্গলবেষ্টিত গর্জনবনের গাছে গাছে বানরদের দৌড়ঝাঁপ। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে পরিবেশটা দারুণ। দূরে দাঁড়িয়ে বীরসেন চাকমা (৫২) ডাক ছাড়লেন, ‘যমুনা, চলে এসো।’ একমুহূর্ত দেরি না করে বীরসেনের কাছে ছুটে এল জঙ্গলের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা যমুনা।

বীরসেন চাকমা (৫২) প্রথম আলোকে বললেন, ‘মানুষ দেখলেই ছুটে আসে যমুনা। মানুষের সঙ্গে খেলাধুলা করতে চায়, মানুষের আদর-ভালোবাসা চায়। মায়া ভুলতে পারে না যমুনা। জন্মের চার মাস পর এতিম যমুনা।’

১ বছর ৭ মাস বয়সী যমুনা একটি হাতিশাবকের নাম। শাবকটি আছে কক্সবাজার শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালে। সেখানে শাবকটির চিকিৎসা ও লালন–পালন চলছে। যমুনাকে দেখভালের দায়িত্ব মাহুত বীরসেন চাকমার।

২০২১ সালের ১০ মার্চ টেকনাফের সংরক্ষিত বন থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল চার মাস বয়সী হাতিশাবকটি। প্রসবের কিছুদিন পর বনাঞ্চলের পাহাড় থেকে নিচে ছিটকে পড়ে মারা গিয়েছিল মা হাতিটি। এরপর বিপদে পড়ে শাবকটি। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মীরা জঙ্গল থেকে শাবকটি উদ্ধার করে লালন–পালনের জন্য প্রেরণ করেন সাফারি পার্কে। পার্ক কর্তৃপক্ষ শাবকটির নাম রাখে ‘যমুনা’।

মানুষের মায়ায় যমুনা

সাফারি পার্কের মধ্যভাগে গর্জনবনের ভেতরে বন্য প্রাণী হাসপাতাল। হাসপাতাল ভবনের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে ৪০-৫০ শতকের একটি বেষ্টনী। সেখানে দিনের বেলায় খেলাধুলায় সময় কাটে যমুনার। আর রাতের বেলায় থাকতে হয় হাসপাতালের আইসোলেশন কক্ষে।

ডাক শুনে যেভাবে হাতিশাবকটি তেড়ে আসছিল, প্রথমে সবাই ভয় পেয়েছিলাম। কাছে এসে যখন শাবকটি থেমে গেল শঙ্কা দূর হলো।
জিল্লুর রহমান, দর্শনার্থী

গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় গিয়ে দেখা গেল, গর্জনগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে যমুনা। কয়েকটা বানর আশপাশে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছিল। যমুনার ২০০-২৫০ গজ দূরে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কয়েক দর্শনার্থী। দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন বীরসেন চাকমা। দর্শনার্থীদের অনুরোধে যমুনাকে ডাকলেন বীরসেন। কাছাকাছি আসতেই ভয় ও আতঙ্কে দর্শনার্থীরা এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছিলেন। সবাইকে আশ্বস্ত করে বীরসেন বলেন, ভয়ের কারণ নেই। যমুনা অনেক শান্ত। মানুষের সঙ্গে খেলতে চায়, কিন্তু আক্রমণ করে না।

মাহুত বীরসেন চাকমার বাড়ি রাঙামাটির বাঘাইছড়ির বঙ্গলতলী গ্রামে। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি বন্য হাতি লালন–পালনের কাজ করছেন। সাফারি পার্কের হাতির দেখভাল করছেন তিন বছর ধরে।

আফরিদ নামের সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া এক শিশু যমুনার কাছে যায়। যমুনা শুঁড় দিয়ে আফরিদের হাত টানাটানি শুরু করে। শিশুটি যেদিকে যায়, যমুনাও সেদিকে ছুটছিল।

স্ত্রী, দুই সন্তানকে নিয়ে রাজশাহী থেকে সাফারি পার্কে এসেছিলেন ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ডাক শুনে যেভাবে হাতিশাবকটি তেড়ে আসছিল, প্রথমে সবাই ভয় পেয়েছিলাম। কাছে এসে যখন শাবকটি থেমে গেল শঙ্কা দূর হলো। আসলে আদর-ভালোবাসা বড় জিনিস।’

প্রতিদিন ভোররাত চারটার দিকে যমুনা ঘুম থেকে জেগে কক্ষের ভেতরে খেলাধুলা শুরু করে। পাঁচটার দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করানো হয়।

বনকর্মীরা বলেন, প্রতিদিন সাফারি পার্ক ভ্রমণে আসেন কয়েক হাজার দর্শনার্থী। কিন্তু যমুনাকে দেখার সুযোগ অনেকের হয় না। দৈনিক ২০০-৩০০ জন দেখতে পান। সবাই যমুনার সঙ্গে ছবি তোলেন, ভিডিও ধারণ করেন। অনেকে যমুনাকে খাওয়াতে চান, কিন্তু নিষেধ আছে।

যেভাবে দিন কাটে যমুনার

সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রথম যখন হাতিশাবকটি পার্কে আনা হয়েছিল, তখন অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। মুখ ও পায়ে আঘাতের দাগ ছিল, ওজন ছিল ১২১ কেজি। বর্তমানে শাবকের ওজন ৫৫০ কেজি। আগে হাতিশাবকের খাবারের পেছনে দৈনিক খরচ হতো পাঁচ হাজার টাকা। এখন সাড়ে তিন হাজার টাকা। আগে দুধ-দই বেশি খাওয়ানো হতো, এখন দুধ কমিয়ে কলাগাছ ও সবজি খাওয়ানো হচ্ছে। এখন প্রতিদিন ৬ প্যাকেট ল্যাকটোজেন দুধ, ১২০-১৩০টি দেশীয় কলা, জাউভাত (নরম ভাত) ও সবজি খাওয়ানো হচ্ছে। এতে শরীরের ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যমুনার বয়স এখন এক বছর সাত মাস। পার্কেই কেটেছে এক বছর দুই মাস। এখনো শাবকটি নিজে নিজে খেতে অভ্যস্ত নয়। কিছুদিন ধরে কলাগাছের ভেতরের অংশটা (বলি) টুকরা টুকরা করে খাওয়ানো হচ্ছে। নিজে নিজে খাবার শুরু করলে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেওয়া হবে।

শাবকটির অবস্থা দেখতে এসেছিলেন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে। সবকিছু নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। মানুষ দেখলে যমুনা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। মানুষের মায়া ভুলতে পারেনা শাবকটি। পার্কে আরও পাঁচটি হাতি থাকলেও যমুনাকে ওদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া হচ্ছে না।

চার মাস বয়স থেকে যমুনার কাছাকাছি থাকছেন বীরসেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোররাত চারটার দিকে যমুনা ঘুম থেকে জেগে কক্ষের ভেতরে খেলাধুলা শুরু করে। পাঁচটার দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করানো হয়। তারপর পাকা সড়ক ধরে কুমির লেক পর্যন্ত আধা ঘণ্টা হাঁটানো হয়।

যমুনার দৈনন্দিন রুটিনের বর্ণনা দিয়ে বীরসেন বলেন, সকালে হাঁটাহাঁটি-ব্যায়ামের পর বেষ্টনীতে এনে গোসল করানো হয়। খাওয়ানো হয় দুধ-কলার সঙ্গে জাউভাত ও কলাগাছের বলি। দুপুরে পাঁচ কেজি সবজি খাওয়ানো হয়। বিকেলে যমুনা ব্যস্ত থাকে মানুষের সঙ্গে খেলাধুলায়। বিকেলে আরেকবার দুধ খাওয়ানো হয়। সন্ধ্যায় কক্ষে পাঠিয়ে যমুনাকে খেতে দেওয়া হয় কলাগাছের বলি। রাতে মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য কয়েল জ্বালিয়ে রাখা হয়।