নতুন পদ্ধতির প্রশ্নপত্র শিক্ষকদেরই অনেকে বুঝছেন না, শিক্ষার্থীরা বিপাকে

এনসিটিবি

সকাল পৌনে ১০টা। কক্ষের ভেতরে-বাইরে শিক্ষার্থীদের শোরগোল। ঘড়ির কাঁটায় ১০টা বাজার সঙ্গে স্কুলে এসে হাজির ২২ শিক্ষক-কর্মচারী। বেলে টুং টাং শব্দ। শোরগোল ভেঙে বাইরের শিক্ষার্থীরা স্কুলের বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে পড়ল। হন্তদন্ত হয়ে খাতা ও প্রশ্নপত্র হাতে কক্ষে ঢুকলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভাষায় ‘পরীক্ষা’ বলা হলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভাষায় শিক্ষার্থীদের ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন।

শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একজন শিক্ষক হন্তদন্ত হয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে এলেন। বললেন, ‘স্যার, এসব কি প্রশ্ন! সবাই (শিক্ষার্থী) হাঁ করে বসে আছে। কিছুই তো বুঝতেছে না। ভিডিও দেখাওচি, তা-ও বোঝে না। এখন কী করব?’ প্রধান শিক্ষক সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের একজন শিক্ষকের নাম বলে পরীক্ষাকক্ষে তাঁকে নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা শিক্ষক আবার প্রধান শিক্ষককে বললেন, ‘স্যার ওই শিক্ষক গিয়ে কী করবেন! ছাত্ররা তো লিখতেই পারছে না।’

অগত্যা প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন ওই শিক্ষক। এরপর সেখানে প্রবেশ করেন বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক। কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এটা কোন ধরনের পরীক্ষা, বুঝলাম না।’

শনিবার রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার একটি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক পরীক্ষাকক্ষে ঢুকে দেখা গেল, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন চলছে। শিক্ষার্থীরা বই খুলে প্রশ্নপত্রের উত্তর খুঁজে খাতায় লিখছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরাও তাঁদের সহযোগিতা করছেন।

সকাল ১০টায় মূল্যায়ন শুরু হলেও বেলা ১১টা পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণির তিনজনকে পাওয়া গেল, যারা খাতায় কিছুই লেখেনি। প্রশ্নপত্রসহ সাদা খাতা বেঞ্চের ওপরে রেখে চুপচাপ বসে আছে। একজন শিক্ষার্থী বলল, ‘স্যার, ইগলা (এসব) হামরা পড়ি নাই।’ আরেকজন বলল, ‘ইগলা হামার বইয়োত নাই। হামরা প্রশ্ন পইড়বার পাওচি না।’

শিক্ষার্থীদের মুখে এসব শুনে কক্ষে দায়িত্বরত এক শিক্ষক বলেন, ‘ষষ্ঠ শ্রেণির প্রশ্ন এসেছে, সবুজ বনায়ন সম্পর্কে ইংরেজিতে লিখতে হবে। এ জন্য শিক্ষার্থীকে সবুজ বনায়নের ওপর কমপক্ষে পাঁচটি প্রশ্ন ইংরেজিতে তৈরি করে ইংরেজিতেই জবাব লিখতে হবে। গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অনেক শিক্ষার্থী নিজের নামও ইংরেজিতে লিখতে বা পড়তে পারে না। তারা কীভাবে ইংরেজিতে প্রশ্ন তৈরি করে জবাব লিখবে? বাংলায়ও তো লিখতে পারে না।’

বিভিন্ন কক্ষের দায়িত্বরত একাধিক শিক্ষক জানান, নতুন প্রশ্নপত্রের অনেক কিছু তাঁরাই (শিক্ষক) ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না। পড়িয়েছেন একভাবে, প্রশ্ন এসেছে আরেকভাবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা বুঝবে কীভাবে?

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, নতুন পদ্ধতির প্রশ্নপত্র শিক্ষকেরাই ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না, শিক্ষার্থীরা কীভাবে বুঝবে? ৩ জুলাই স্কুলে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হয়েছে, চলবে ৩ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর নির্দেশনা মোতাবেক দুই সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করে নির্ধারিত ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপে ইনপুট দিতে হবে।

তবে দুপুর সাড়ে ১২টায় আরেকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও একই প্রশ্নপত্রে মূল্যায়ন চলছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে একটি কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, শিক্ষার্থীরা খাতায় লিখছে। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলে, ‘স্যার প্রশ্ন বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন লিখছি। সমস্যা হচ্ছে না।’ প্রধান শিক্ষক হেলাল হোসেন বলেন, ‘গত রাত ১২টা পর্যন্ত স্কুলে বসেছিলাম আজকের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করার জন্য। কিন্তু ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারছিলাম না। পরে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা নিতে ও দিতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মুখস্থনির্ভরতা থাকবে না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজ সারা দেশের সব স্কুলে শিক্ষার্থীদের অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ইংরেজি, সপ্তমে শিল্প ও সংস্কৃতি, অষ্টমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নবম শ্রেণিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে মূল্যায়ন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জিপিএ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন না করে অনন্য, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক ক্যাটাগরিতে মূল্যায়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে যারা সর্বোচ্চ ভালো করবে, তাদের ক্যাটাগরি হবে ‘অনন্য’।