খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব, শিকড়ে ফেরা, রঙে রাঙানো একদিন
চৈত্রের শেষ বিকেল। সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। ফিকে হতে শুরু করেছে দিনের আলো। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের নীলাভ আকাশে তখন শত রঙিন ঘুড়ির মেলা। কোনোটা সাদা, কোনোটা লাল, কোনোটা বেগুনি। রঙের বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ির আকার ও নামেও আছে বৈচিত্র্য। শত শত নারী-পুরুষ, শিশুরা রঙিন ঘুড়ির নেশায় মত্ত।
ঘুড়ি নিয়ে কেউ ছবি তুলছেন, কেউবা ওড়াতে ব্যস্ত। আবার কারও কারও ঘুড়ি না ওড়ায় হতাশ, তবে আকাশে ওড়াতে চেষ্টার শেষ নেই। অন্যদিকে চলছে মোরগ লড়াই, দড়ি টানাটানি খেলা। মাঠের একপাশে নাগরদোলায় চলছে উল্লাস। ছবি, সেলফি আর আড্ডায় খেলার মাঠটি যেন রঙে রঙিন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের আয়োজনে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবে রোববার বিকেলে এভাবেই মেতে উঠেছিলেন সবাই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নন, সেই আনন্দে শরিক হয়েছিলেন খুলনার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আনন্দ আর প্রাণের এমন উচ্ছ্বাস যেন হারিয়ে যাওয়া এক গ্রামবাংলার চিত্র ফুটে ওঠে মাঠে। ক্লাস আর পরীক্ষার একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা এই দিনটিতে নিজেদের সংস্কৃতি ও শিকড়ের সঙ্গে মিশে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. আবু জাজিম বেশ বড় একটি বাক্স ঘুড়ি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তা ওড়াতে পারছিলেন না। তবে ঘুড়ি না উড়লেও ভিন্ন ধরনের ওই ঘুড়ি নিয়ে ছবি তোলার মানুষের কমতি ছিল না। আবু জাজিম বললেন, ‘নিজের হাতে ঘুড়ি বানিয়েছি, কিন্তু পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় ঘুড়ি ওড়াতে পারছি না। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে ঘুড়ির মেলা বসেছে। গতবারের তুলনায় এবার ঘুড়ির সংখ্যা অনেক বেশি।’ তিনি আরও বলেন, আধুনিক যুগে এসে মানুষ গ্রামবাংলার সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে। এ কারণেই চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা বর্ষবরণ উৎসব সাজানো হয়েছে গ্রামবাংলার উৎসবের সংস্কৃতি ও খেলাধুলা নিয়ে।
ইংরেজি ডিসিপ্লিনের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তামান্না রহমান বলেন, ‘ঘুড়ি ওড়ানো, মোরগ লড়াই, লাঠিখেলা, আমাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। বর্তমান প্রজন্ম এই সংস্কৃতি ভুলতে বসেছে। এ ধরনের আয়োজন অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র তৈরিতে কাজ করে।’
ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোর্ত্তুজা আহমেদ উৎসবে এসেছিলেন স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে। তাঁদের নিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি। খুবই ভালো লাগছে। আমাদের ছোটবেলার খেলাধুলা কেমন ছিল, ছেলেরা তা জানতে পারছে।’
বিকেল চারটার দিকে ঘুড়ি উড়িয়ে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম। এরপর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ফিতা কেটে দিবসের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে ছিল ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খেলা, ঘুড়ি উৎসব, আলপনা উৎসব, পুতুলনাচ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপাচার্য মো. রেজাউল করিম বলেন, চৈত্রসংক্রান্তি বাঙালির একটি চিরায়ত উৎসব, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে প্রবাহিত হয়ে আসছে। ঘুড়ি উৎসব সেই ঐতিহ্যেরই রঙিন প্রতিফলন। এ ধরনের আয়োজন শুধু বিনোদনের নয়, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্র হিসেবেও এমন আয়োজনগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. হারুনর রশীদ খান, ছাত্রবিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুস সাদাত, সহকারী ছাত্রবিষয়ক পরিচালক তারেক বিন সালাম, নীপা অধিকারীসহ বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
উৎসবে আসা ব্যক্তিরা বলছেন, এ উৎসব শুধু বিনোদনের উপলক্ষ নয়, বরং বাঙালির শিকড়ে ফেরার একটি চেতনাও। প্রযুক্তিনির্ভর একালের তরুণেরা যখন নিজেদের লোকজ ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে, তখন এমন এক উদ্যোগ শুধু উৎসব নয়—সংস্কৃতি সংরক্ষণের এক প্রাণান্ত চেষ্টা। চৈত্রসংক্রান্তি তো গ্রামবাংলায় অনেক আগে থেকেই ছিল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন করে উদ্যাপন দেখে মনে হলো—‘আমরা আবার শিকড়ে ফিরছি।’
চৈত্রসংক্রান্তির এমন উৎসব প্রতিবছরেই যেন ফিরে আসে, রঙে রাঙাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রান্ত—এমনটাই আশা শিক্ষার্থীদের।